ডেঙ্গি রোগীর প্লেটলেট বাড়ানোর ব্যাপারে তার কার্যকারিতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছয়লাপ। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমে রোগীদের সেই ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে বলেও খবর মিলছিল এত দিন। ফলে ইন্টারনেটে বা ওষুধের দোকানে সেই ওষুধ বিকোচ্ছিলও দেদার। এ বার সরকারি হাসপাতালের অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের কেউ কেউ পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি ওষুধ খাওয়ার নিদান দেওয়ায় অস্বস্তিতে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর।
টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি দুই রোগী নারায়ণ দাস ও অমিত নাথের ‘মেডিসিন স্লিপ’ আনন্দবাজারের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত বৃহস্পতিবার পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধ ‘ট্যাব ক্যারিজেন’ কিনতে বলেছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য, ‘‘সরকারি হাসপাতালে কাউকে ওষুধ কেনানোর নিয়ম নেই। অ্যালোপ্যাথি হাসপাতালে আয়ুর্বেদিক ওষুধ দেওয়ারও প্রশ্ন নেই। এই বেআইনি কাজ কারা করলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ যদিও হাসপাতালের সুপার তাপস ঘোষ বলেন, ‘‘এমন কিছু হয়েছে বলে শুনিনি।’’ এখন প্রশ্ন, প্লেটলেট বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই ধরনের ওষুধ কতটা কার্যকরী? এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই বা কী? আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চিরাচরিত চিকিৎসা হিসেবেই পেঁপে পাতার রসের ব্যবহার চলে আসছে। যেমন কাশি হলে তুলসি পাতা, রক্ত বাড়াতে কুলেখাড়া পাতার রস খাওয়ানোর কথা বলা হয়, এটাও ঠিক তেমন। কিন্তু পেঁপে পাতার রস থেকে তৈরি ট্যাবলেট কতটা কাজে দেবে, তা নিয়ে অনেক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকই সন্দিহান। ভারত সরকারের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আয়ুর্বেদ’-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অসিত পাঁজা যেমন স্পষ্টই বলছেন, ‘‘পেঁপে পাতা ও গুলঞ্চের কাঁচা রস একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে রক্তে প্লেটলেট যে বাড়ে, তা অনেক গবেষণায় প্রমাণিত। কিন্তু এখন অনেকে ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট খাচ্ছেন। এর কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়।’’
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের বড় অংশ এমন ওষুধের কার্যকারিতা মানতে নারাজ। পরজীবীঘটিত রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর কথায়, ‘‘কলকাতার নামী-অনামী হাসপাতালের অনেক চিকিৎসকই ডেঙ্গি পেঁপে পাতার রসের ট্যাবলেট লিখে দিচ্ছেন। দেখলেই কেটে দিচ্ছি। কারণ, এতে তেমন লাভ হয় কিনা, তার প্রমাণ পাইনি। বরং এই ট্যাবলেট খেয়ে বমি-পেটখারাপ হয়েছে।’’
এক শ্রেণির চিকিৎসকেরা তবে এই ওষুধ লিখছেন কেন? হাসপাতাল সূত্রের খবর, রোগী বা তাঁদের আত্মীয়দের অনেকেই বিভিন্ন সূত্রে পেঁপে পাতার রসের কথা শুনে সেই ওষুধ দেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করছেন। মওকা বুঝে এই ধরনের ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরা এসে চিকিৎসকদের ওই ওষুধ লেখার বিনিময়ে কমিশনের টোপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ। সেই টোপ এক শ্রেণির চিকিৎসক গিলছেনও।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গি রোধের নিদান আরও আছে। সে সব দেখে কেউ পেয়ারা পাতা চিবিয়ে বা বেটে খেয়ে ফেলছেন, কেউ ডেঙ্গির মশা তাড়াতে ঘরে লেবু কেটে তাতে লবঙ্গ গুঁজে তার উপরে হিং ছড়িয়ে রাখছেন! ‘‘ডেঙ্গি হলে বেশি জল খাওয়াতে হয় শুনে ৮ বছরের শিশুকে দিনে ১০ লিটার জল খাওয়ানোও হয়েছে। ফলে তার হাত-পা ফুলে প্রাণ যায় যায়’’— বলছেন অমিতাভবাবু।