জনারণ্য। (বাঁ দিকে) দার্জিলিঙের ম্যালে তিল ধারণের জায়গা নেই। (ডান দিকে) লাটাগুড়ির প্রকৃতি পরিচিতি কেন্দ্রের টিকিট কাউন্টারে ভিড়। — রবিন রাই ও দীপঙ্কর ঘটক
পাহাড় ও ডুয়ার্সে যেন পর্যটকদের মেলা বসেছে। পা ফেলার জায়গা নেই। ম্যাল যেন ব্যস্ত সময়ের শিয়ালদহ, লাটাগুড়ি যেন ধর্মতলা। গ্রীষ্মের মরসুমের শুরু থেকেই পর্যটকদের ভিড় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে দার্জিলিঙে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে গরমের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে পর্যটকের ভিড় রেকর্ড ছুঁয়েছে। হোটেল-রিসর্টে জায়গা না পেয়ে হোম স্টে-র ঘর খুঁজে পেতে শহর লাগোয়া পাহাড়ি গ্রামে ছুটছেন পর্যটকেরা। সেখানেও ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই রব। দার্জিলিঙের ম্যাল থেকে মিরিকের লেক সর্বত্র গিজগিজ করছে ভ্রমণপিপাসুদের দল। সেই সঙ্গে চলছে টয় ট্রেনের টিকিট এবং গরুমারা-চাপরামারির জঙ্গল সাফারিতে জায়গা পাওয়ার জন্য হাহাকার। দার্জিলিঙের চিড়িয়াখানায় প্রতিদিন ৫ হাজার পর্যটক যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে পর্যটনে জমজমাট ডুয়ার্স থেকে দার্জিলিং।
সর্তক পুলিশ
পাহাড়ের সব থানা এবং ফাঁড়িতে সর্তকবার্তা এসেছে দিন পনেরো আগে। পাহাড়ে কোনও আন্দোলন নেই, স্বাধীনতা দিবসেরও ঢের দেরি। হঠাৎ ‘অসময়ে’ সদা-সর্তক থাকার নির্দেশ পেয়ে প্রথমে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলেন পুলিশ অফিসারদের অনেকেই। পরবর্তীতে জেলা পুলিশ লাইন থেকে বিস্তারিত ভাবে সর্তকবার্তার কারণ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সে কারণেই অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে এবং পর্যটকদের সাহায্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন এবং নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গরুমারা জঙ্গলের সাফারির টিকিট জোগাড়ের লাইন সামলাতে লাটাগুড়িতেও মোতায়েন করা হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের দল। দার্জিলিঙের পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার পর্যটক দার্জিলিং শহরে ঢুকছেন। সর্বত্র ভিড়। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি পুলিশি বন্দ্যোবস্ত রাখতেই হয়েছে।’’
এ তো মণ্ডপের লাইন
গ্রীষ্মের দার্জিলিং পর্যটকের ভিড়ে ফি বছরই জমজমাট থাকে। তবে এ বারের ভিড় অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছে। রবিবার দুপুরে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ম্যাল জুড়ে ছাতার মেলা। ম্যাল লাগোয়া মহাকাল রোড বাজার, চৌরাস্তা বাজারে পর্যটকদের হেঁটে যেতেও ভিড়ের জন্য বারবার থমকাতে হয়েছে। সন্ধ্যের পরেও নেহরু রোডে ভিড় লেগেই রয়েছে। কলকাতার থেকে দার্জিলিঙে ঘুরতে আসা সরকারি শুভাশিস দত্ত বললেন, ‘‘এত ভিড় হবে, তা পাহাড়ে পা ফেলার আগে বুঝতে পারিনি। গুলিয়ে যাচ্ছে দার্জিলিঙে রয়েছি নাকি কলকাতার পুজোমণ্ডপের লাইনে।’’
দিনে পাঁচ হাজার
ভিড়ে মেলার চেহারা নিয়েছে দার্জিলিং চিড়িয়াখানা এবং উদ্যানগুলি। রিচমন্ড হিল লাগোয়া নাইটেঙ্গল পার্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই গড়ে প্রতিদিন ৪ হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। টিকিট কেটে ঢুকতে হয় পদ্মজা নাইডু চিড়িয়াখানাতেও। কর্তৃপক্ষ জানালেন, গড়ে ৫ হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে রোজ। এ দিন রবিবার দুপুরের মধ্যেই টিকিট বিক্রির সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। সকলেই যে দার্জিলিঙে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন, এমন নয়। বনগাঁর বাসিন্দা দেবত্তোম পালকে দিনভর থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে দার্জিলিং থেকে। তাঁর কথায়, ‘‘অফিসের ছুটির ঠিক ছিল না। তাই আগে থেকে বুকিং করিনি। এসে দেখি কোথাও ভাল ঘর নেই। তাই সারা দিন কাটিয়ে শিলিগুড়ি ফিরতে হবে।’’
বিপাকে রেল কর্তারা
পর্যটকদের ভিড় সামলাতে নাকাল দার্জিলিং হিমালয়ান রেল কর্তৃপক্ষও। প্রতিদিন সকাল হলেই দার্জিলিং, ঘুম স্টেশনের কাউন্টারে লম্বা লাইন। কেউ এসেছেন হুগলি থেকে, কেউ বা লখনউ। সকলেরই চাহিদা টয় ট্রেনের টিকিট। অনেকে চিকিটের জন্য চড়া দাম দিতেও রাজি। কিন্তু টিকিট নেই। রোজ লম্বা ‘ওয়েটিং লিস্ট’। তাই অতিরিক্ত কামরা লাগানো হচ্ছে। তবু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক রেলকর্তার কথায়, ‘‘পর্যটকরা টিকিট না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন। কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে আমাদের মুণ্ডপাত করছেন। মুখ বুজে সবই সহ্য করতে হচ্ছে।’’ দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত প্রতিদিন ৯টি জয় রাইড হয় টয় ট্রেনের। প্রতি ট্রেনে দু’টি করে কামরা বাড়িয়েও স্থান সংকুলান হচ্ছে না।
জঙ্গলেও জায়গা নেই
পর্যটকদের অনেকেই ভ্রমণ পরিকল্পনা এমন ভাবে করেছেন, যাতে তিন-চার দিনে পাহাড়-জঙ্গল দুই-ই ছোঁয়া যায়। কেউ গরুমারা বা চাপমারি জঙ্গল ঘুরে দার্জিলিং গিয়েছেন, কেউ বা পাহাড় থেকে ফিরতি পথে লাটাগুড়ি পৌঁছেছেন। লাটাগুড়িতে এখন পর্যটক বোঝাই গাড়িতে যানজট হওয়ার জোগার। লাটাগুড়ি হোক বা মূর্তি সরকারি-বেসরকারি কোনও রিসর্টে বুকিং তো বটেই একদিনের জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় সাফারি করতে বেসরকারি সংস্থার ভাড়ার গাড়ি পাওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে পর্যটকরা অনুযোগ করছেন। এক পর্যটকের কথায়, ‘‘যাব কোথায় বলুন তো? যেখানেই যাচ্ছি হয় শুনতে হচ্ছে টিকিট শেষ, নয়তো গিয়ে দেখছি ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই।’’
কেন বাড়ছে ভিড়?
উত্তরবঙ্গের ট্যুর অপারেটররা জানাচ্ছেন, মূলত দু’টি কারণে এবারে ভিড়ের রেকর্ড করতে চলেছে দার্জিলিং এবং ডুয়ার্স। কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে প্রবল দাবদাহ চলতে থাকায় দার্জিলিং বা তুলনায় মনোরম ডুয়ার্সের পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে ভিড় বাড়ছে। যাঁদের এই সময়ে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল না, তাঁদের অনেকেই গরম থেকে কয়েক দিনের জন্য রক্ষা পেতে হাতের কাছে দার্জিলিংকে বেছে নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, একের পর এক ভূমিকম্পের কারণে নেপাল এবং ধসের কারণে সিকিমে যাওয়ার প্রবণতা কিছুটা কমেছে। দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে বিকল্প গন্তব্য হয়েছে দার্জিলিং-ডুয়ার্স। দার্জিলিঙের ম্যাল রোডের একটি অভিজাত হোটেলের ম্যানেজার দেবীপ্রসাদ শঙ্করের কথায়, ‘‘এই সময়ে দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসা পর্যটকদের ভিড়ই বেশি। গরমে নাকাল হয়ে একদিন ছুটি নিয়ে সপ্তাহান্ত কাটিয়ে যাচ্ছেন এমন পরিবারের সংখ্যা প্রচুর।’’
রেকর্ড ভিড়
ট্যুর অপারেটরদের হিসেবে এ বছর পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। কত পর্যটক দার্জিলিং বা ডুয়ার্সে এলেন, তা জানার কোনও সরকারি সূত্র নেই। তবে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কত পর্যটক এসেছেন তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। সে হিসেবে গত তিন সপ্তাহ পর্যটকের সংখ্যা ৩ লক্ষ ছাড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গের ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন এতোয়ার কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, ‘‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য আমরা নিজেদের মতো করে নানা পরিসংখ্যান তৈরি করি। গত ২০ মে থেকে আগামী ১০ জুন পর্যন্ত কত পর্যটক এসেছেন এবং কতজন আসবেন তারও একটি পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে এই সময়ে অন্তত ৩ লক্ষ পর্যটক আসা যাওয়া করছেন। যা নিজেই একটি রেকর্ড।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy