রাজা দত্ত
দৃশ্যটা প্রায় একই। বদলেছে শুধু সংলাপ!
‘মাস্টারমশাই আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি’র পরিবর্তে, ‘বাড়াবাড়ি হচ্ছে, এ সব বন্ধ করো’।
সেই রাতের অন্ধকার। কিছু যুবকের উদয় হওয়া। চাপা গলা। শীতল চাউনি।
পর্দার মাস্টারমশাই ‘আতঙ্ক’-এ ভুগেছেন। হালিশহরের শক্তিপদ ঘোষ দমেননি। পাল্টা বলেছেন, ‘‘আমরা কিছুই বন্ধ করব না। যা করার করে নাও। ছেলেই যখন আর নেই, তখন কাকে ভয় করব? আমরা আর মরতে ভয় পাই না।’’
শক্তিপদবাবু হালিশহরের নিহত রাজ-অনুচর বান্টির বাবা। উপ-পুরপ্রধান রাজা দত্তের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় কিছু দিন আগেই তাঁকে হুমকি শুনতে হয়েছিল, ‘নাম ফাটলে, মাথা ফাটবে’। তার পরেই ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারের কাছে রাজার বিরুদ্ধে বান্টি-খুনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দায়ের করেছিলেন তার স্ত্রী পায়েল। সেই রাতেই আগুনের গোলা ছুঁড়ে তাঁদের একটি ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তবু পায়েলদের মুখ বন্ধ করা যায়নি। শুক্রবার রাজার বিরুদ্ধে সিআইডি-র কাছে একই অভিযোগ জানিয়ে আসেন পায়েল। ওই রাতেই শক্তিপদবাবুকে ফের হুমকি! এ নিয়ে থানার দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার রাত তখন সাড়ে ৮টা। তেঁতুলতলায় বাড়ির কাছের একটি তেলেভাজার দোকানের সামনে কয়েক জন পরিচিতের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন শক্তিপদবাবু। আচমকা সেখানে যেন মাটি ফুঁড়ে দু’টি মোটরবাইকে পাঁচ ষন্ডামার্কা যুবক উদয় হয়। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে, সরাসরি শক্তিপদবাবুর চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় তারা বলে, ‘‘বাড়াবাড়ি বন্ধ না হলে ১৯ তারিখের পর বাড়ি-ঘর
সব রেখে এখান থেকে চলে যেতে হবে।’’ পাল্টা ফুঁসে ওঠেন শক্তিপদবাবু। তাঁর মূর্তি দেখে যুবকেরা বাইক নিয়ে পালায়।
এখানেই শেষ নয়। রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ তাঁর নাম ধরে বাইরে চিৎকার শুনে শক্তিপদবাবু বাড়ির দোতলা থেকে দেখেন, নীচে দাঁড়িয়ে দুই অপরিচিত যুবক তাঁকে ডাকছে। কিন্তু তিনি নামেননি। বরং দু’টি ঘটনার কথাই ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহকে জানিয়ে এফআইআর করেছেন তিনি। শক্তিপদবাবু এবং স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রাজাই লোক পাঠিয়ে এ ভাবে হুমকি দিচ্ছে। শক্তিপদবাবু বলেন, ‘‘বাইরে থেকে লোক আনিয়ে রাজা হুমকি দিচ্ছে। রাতে যে দুই যুবক আমাকে ডাকছিল, তারা আমার ডেকরেটিংয়ের ব্যবসা নিয়ে কথা বলবে বলেছিল। নীচে নামার জন্য জোর করছিল। কিন্তু অত রাতে কেন ব্যবসার কথা বলব? ওদের অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল।’’
পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ জানান, সব দিকে পুলিশ নজর রাখছে। যে অভিযোগ হয়েছে, তা দেখে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। রাজার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। এসএমএসেরও জবাব মেলেনি।
তবে, শক্তিপদবাবুকে যে ভাবে বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তাতে বিস্মিত হচ্ছেন না এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, রাজা এ ভাবেই কাজ হাসিল করতে অভ্যস্ত। ‘ফোঁস’ করে ভয় দেখানো তার পুরনো নীতি। সিআইডি যদি ফের বান্টি-হত্যা মামলার তদন্ত নতুন করে শুরু করে, তা হলে সে বিপাকে পড়তে পারে— এই আশঙ্কাতেই পুরনো অস্ত্র বারবার ঝোলা থেকে বের করছে রাজা।
কিন্তু আগে যে ‘অস্ত্রে’ আগে এক কথায় কাজ হতো, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা যে খুব একটা কাজে আসছে না তা মানছে রাজার চ্যালারা। কেননা, প্রতিবাদের স্বর জোরালো হচ্ছে। দিন তিনেক আগে বাগমোড় এলাকায় একটি মানবাধিকার সংগঠন এবং স্থানীয় ‘নাগরিক মঞ্চ’-এর যৌথ অনুষ্ঠানে রাজার অবৈধ কারবার নিয়ে মুখ খোলেন বক্তারা। প্রতিরোধের কথাও শোনা যায় মঞ্চ থেকে।
কিন্তু রাজা-বাহিনী কেন বারবার ১৯ মে-র কথা বলছে তা নিয়ে সংশয়ে শহরের বাসিন্দারা। শুক্রবারই রাজার সাকরেদরা জানিয়েছিল, ১৯ তারিখের জন্য ‘দাদা’র পরিকল্পনা রয়েছে। তাই শ’দুয়েক জর্দা-কৌটো কেনা হয়েছে। তা থেকে কৌটো-বোমা বানানো হবে কিনা, তা নিয়ে শুরু হয়ে যায় জল্পনা। এ বার শক্তিপদবাবুকেও ১৯ মে-র কথা বলে ওই হুমকির পরে কেউ কেউ মনে করছেন, সে দিন ভোটের ফল প্রকাশ হবে। তার পরে গোলমাল হতে পারে।
রাজার সাকরেদদের একাংশ দাবি করেছে, ভোটে তৃণমূলই রাজ্যের গদি দখল করবে বলে ধারণা ‘দাদা’র। তা হলে পুলিশ প্রশাসনও তাদের হবে। তখন ‘দাদা’র খেল শুরু হবে সেই পুরনো স্টাইলেই।
কিন্তু পাশা যদি উল্টে যায়? তখনও কি ‘রাজ-মহিমা’ অটুট থাকবে? এ প্রশ্ন ওঠাও শুরু হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy