Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মাস্টারমশাইদের উদ্যোগ কাজে এল, মিলল মদ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি

মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে কথা বলার অভ্যাস নেই কোনও কালে। তাই বেশ জড়সড় দেখাচ্ছিল নেপালচন্দ্র পাড়ুইকে। তবু বললেন, “গ্লাস-বোতল ভেঙে শপথ করছি, আর কখনও মদ ছোঁব না। মদ খেলে রোজগারের টাকা সব শেষ হয়ে যায়। নেশার ঝোঁকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। ও সব ঢের হয়েছে। আর নয়।”

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৪ ০০:৪৭
Share: Save:

মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে কথা বলার অভ্যাস নেই কোনও কালে। তাই বেশ জড়সড় দেখাচ্ছিল নেপালচন্দ্র পাড়ুইকে। তবু বললেন, “গ্লাস-বোতল ভেঙে শপথ করছি, আর কখনও মদ ছোঁব না। মদ খেলে রোজগারের টাকা সব শেষ হয়ে যায়। নেশার ঝোঁকে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। ও সব ঢের হয়েছে। আর নয়।” নেপালের ঘোষণা শুনে উপস্থিত কয়েক হাজার মানুষের হাততালির শব্দে তখন কান পাতা দায়। মহিলাদের কাউকে কাউকে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতেও দেখা গেল।

বসিরহাটের রাজেন্দ্রপুর পঞ্চায়েতের আন্দুলপোতা গ্রামের বাসিন্দা নেপাল। দীর্ঘ দিন ধরে নেশা করেছেন। তাঁরই মতো অবস্থা ছিল ভবসিন্ধু পাড়ুই, টেনা পাড়ুই, অনু পাড়ুই, লক্ষ্মণ মণ্ডল, অজিত মণ্ডল-সহ গ্রামের আরও অনেকের। সকলেরই ‘দিন আনি দিন খাই’ দশা। মদের পিছনে টাকা উড়িয়ে এক দিকে যেমন নিজেদের পরিবারে আর্থিক অনটন টেনে এনেছেন, তেমনই বাড়ির লোকজনের সঙ্গে সম্পর্কও তলানিতে এসে ঠেকেছে।

কিন্তু এঁরা অনেকেই রবিবার এক অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে জানালেন, মদ ছাড়বেন। বহু মানুষের সামনে বোতল ভেঙে নতুন জীবনের শপথ নিলেন। কিন্তু কোন জাদুতে সম্ভব হল এমনটা?

এর উত্তর খুঁজতে গেলে জানতে হবে গ্রামেরই বাসিন্দা আসমত আলির উদ্যোগের কথা। বছর বারো আগে পেশায় ব্যবসায়ী ওই ব্যক্তি গ্রামে একটি মাদ্রাসা তৈরির উদ্যোগ করেন। চেয়েচিন্তে টাকার জোগাড় করে তৈরি হয় আন্দুলপোতা মাদ্রাসা রহমানিয়া। মেয়েদের শিক্ষার উপরেও জোর দেন তাঁরা। আবার মাদ্রাসার উদ্যোগে গ্রামের মানুষের মধ্যে মদ ছাড়ানোর জন্যও প্রচার শুরু হয়। তারই সুফল দেখা গেল এ দিনের অনুষ্ঠানে।

আসমত জানান, এই এলাকায় শিক্ষার অভাব তো আছেই। তার উপরে আছে নেশার জন্য পারিবারিক অশান্তির দীর্ঘ ইতিহাস। গ্রামে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যও বাড়ে এ সবের জেরে। সে জন্যই মদ ছাড়ার কথা বোঝানো শুরু হয়েছিল গ্রামের কিছু পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আসমতের অভিজ্ঞতা, কেউ কেউ সেই প্রচার কানে তোলেনি। কেউ কটূ কথা বলেছে। কিন্তু হাল ছাড়েননি আসমতরা। দিনের পর দিন ধরে চলেছে কাউন্সেলিং। শেষমেশ রাজি হয়েছেন বেশ কয়েক জন। মাদ্রাসার তরফ থেকে তাঁদের এ দিনের অনুষ্ঠানে কিছু নগদ টাকাও দেওয়া হয়েছে। সত্যি সত্যিই যদি পাকাপাকি ভাবে মদ ছাড়েন তাঁরা, তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দেবেন, এই প্রতিশ্রুতিও মিলেছে। মাদ্রাসার শিক্ষক সাজ্জাত হোসেন, সেলিমুল্লা মণ্ডল, নুরুল ইসলামরা জানালেন, নিয়মিত ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি পড়ুয়াদের অভিভাবকদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন। বুঝিয়েছেন, নেশার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির কথা। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছু ক্ষেত্রে যে সাফল্য এসেছে, তা ভবিষ্যতে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের অনুপ্রেরণা হবে।

ভবসিন্ধুবাবুও মদ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, “স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আট জনের সংসার। খালে-বিলে মাছ ধরে আর একশো দিনের কাজ করে কিছু টাকা মেলে। কিন্তু সেই সামান্য আয়ের বেশির ভাগটাই খরচ করে ফেলতাম মদের পিছনে। বাড়িতে এ নিয়ে কত অশান্তিই না হয়েছে। মাদ্রাসার মাস্টারমশাইরা অনেক করে বুঝিয়েছেন। শেষমেশ ঠিক করে ফেললাম, আর ও পথে হাঁটব না।”

অনু পাড়ুইয়ের কথায়, “মদের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতিও করেছি। এখন বুঝতে পারছি, কত বড় সর্বনাশ ডেকে এনেছি সংসারে। মদ খেলে সংসার এবং গ্রামের পরিবেশেরও ক্ষতি। ঠিক করেছি, আর ছাইপাঁশ গিলব না।”

স্বপ্না পাড়ুই, ঝুমা পাড়ুই, মিনা পাড়ুইরা সাধুবাদ জানাচ্ছেন মাদ্রাসার এ হেন উদ্যোগকে। তাঁদের বক্তব্য, “আমরা তো ভাল কথায় বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কত অশান্তিই না হয়েছে এ সব নিয়ে। এখন যদি সত্যি ওঁরা নেশা ছাড়েন, তা হলে বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nirmal basu basirhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE