Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সিসিটিভি ছবির সূত্র ধরে নৃশংস খুনের কিনারা

সূত্র বলতে ছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দির চত্বরে সিসিটিভি-র ফুটেজ আর পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ। শুধুমাত্র এই তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই ঘটনার ২৩ দিন পরে লিলুয়ার বাসিন্দা, প্রৌঢ়া মেনকা বিশ্বাসের চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার কিনারা করে ফেলল পুলিশ। খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে ওই মহিলার পাশের বাড়ির বাসিন্দা শম্ভু রায় এবং তাঁর জামাই অমরেন্দ্র গোস্বামী নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৫৫
Share: Save:

সূত্র বলতে ছিল দক্ষিণেশ্বর মন্দির চত্বরে সিসিটিভি-র ফুটেজ আর পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ।

শুধুমাত্র এই তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই ঘটনার ২৩ দিন পরে লিলুয়ার বাসিন্দা, প্রৌঢ়া মেনকা বিশ্বাসের চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার কিনারা করে ফেলল পুলিশ। খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে ওই মহিলার পাশের বাড়ির বাসিন্দা শম্ভু রায় এবং তাঁর জামাই অমরেন্দ্র গোস্বামী নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গত ১৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার রাতে লিলুয়ার ডি রোডের বাড়ি থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান বছর পঞ্চান্নর মেনকাদেবী। বাতের যন্ত্রণায় যে মহিলা ভাল করে হাঁটাচলাই করতে পারেন না, তিনি কী ভাবে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেলেন, তা নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরের দিন, ১৪ তারিখ সকালে দক্ষিণেশ্বর ফেরিঘাটের কাছে বিছানার চাদর ও প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া অবস্থায় এক মহিলার কাটা মুণ্ড উদ্ধার হয়। ওই মৃতদেহের কানে সোনার দুল ও নাকছাবি দেখে পরিজনেরা মেনকাদেবীকে শনাক্ত করেন। পুলিশ খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে। এর তিন দিন পরে, ১৭ তারিখ ভোরে লিলুয়ার ভট্টনগরের একটি ভেড়ি থেকে একই ভাবে বিছানার চাদর ও প্লাস্টিক জড়ানো অবস্থায় এক মহিলার বুক ও পেটের অংশ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়, দু’টি অংশই একই চাদরের এবং দেহাংশটি মেনকাদেবীরই। কিন্তু ধোঁয়াশা তৈরি হয় কয়েকটি প্রশ্ন ঘিরে। প্রথমত কে বা কারা, কী কারণে ওই অসুস্থ মহিলাকে খুন করল? কোথায় খুন করা হল তাঁকে? বাকি দেহাংশগুলি কোথায়?

এই প্রশ্নগুলি সামনে রেখে ঘটনার তদন্ত এগোয় পুলিশ। লিলুয়া থানার ওসি মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করা হয়। সেই দলে রাখা হয় হাওড়া সিটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কয়েক জন অফিসারকে। তদন্তকারীরা জানান, প্রথমে কোনও সূত্র না পেয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সিসিটিভি-র ফুটেজে ১৪ তারিখ সকালে কে কে ঘাটে গিয়েছিলেন, তা দেখতে শুরু করেন তাঁরা। প্রায় ১৭ ঘণ্টা ধরে ওই ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যায়, ১৪ মার্চ সকাল ৬টা বেজে ৪ মিনিটে শম্ভু মোটরবাইকে করে দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে ফিরছেন। এর পাশাপাশি তদন্তকারীরা জোয়ার-ভাটার হিসেব করে দেখেন, ঘটনার দিন ঠিক ওই সময়েই গঙ্গায় ভাটা চলছিল। তাই দক্ষিণেশ্বর ঘাট থেকে যদি মুণ্ড ফেলা হয়, তা হলে সেটি বেশি দূরে যাওয়ার কথা নয়। সে কারণেই গত ১৪ তারিখ মুণ্ডটি কেন ফেরিঘাটের কাছে উদ্ধার হয়, তা পরিষ্কার হয়ে যায় তদন্তকারীদের কাছে।

মূলত এই দূটি সূত্র যোগ করার পরেই মেনকাদেবীর প্রতিবেশী শম্ভুর উপরে নজরদারি শুরু করে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি রেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন। খবর নিয়ে পুলিশ এ-ও জানতে পারে, ঘটনার পরের দিন, অর্থাৎ ১৪ মার্চ তিনি অফিসে যাননি। লিলুয়ার ডি রোডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, মেনকাদেবী যে দিন নিখোঁজ হন, সে দিনই সন্ধ্যায় তাঁকে শম্ভুর বাড়িতে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল। এই তথ্য জানার পরেই পুলিশ শম্ভুর উপরে নজরদারি বাড়ায়। এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, গত এক সপ্তাহে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই থাকছিলেন না ওই ব্যক্তি। এতেই সন্দেহ বাড়ে। মঙ্গলবার পুলিশ শম্ভুুকে আটক করে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা শুরু করে। পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে ওই ব্যক্তি খুনের ঘটনার কথা স্বীকার করেন।

পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে শম্ভু জানান, ১৩ মার্চ মেনকাদেবী তাঁর বাড়িতে টিভি দেখতে এসেছিলেন। তখন বাড়িতে আর কেউ ছিল না। তখন তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ওই প্রৌঢ়ার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। মেনকাদেবী চিৎকার করে ওঠেন। বাড়িতে পোষা দুটো কুকুরও একই সঙ্গে চিৎকার করতে থাকে। পুলিশের ধারণা, সে কারণেই আশপাশের লোকজন ওই প্রৌঢ়ার চিৎকার শুনতে পাননি। পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে শম্ভু কবুল করেন, চিৎকার বন্ধ করতে মেনকাদেবীকে প্রচণ্ড মারধর করেন তিনি। এর পরে মুখ চেপে ধরে তাঁকে বাথরুমে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মাথা সজোরে দেওয়ালে ঠুকে দেন। পুলিশের ধারণা, এতেই ওই অসুস্থ মহিলার মৃত্যু হয়।

পুলিশ জানায়, মেনকাদেবীর মৃত্যু হলে শম্ভু কোনা নস্করপাড়ার বাসিন্দা জামাই অমরেন্দ্রকে ফোন করে তাড়াতাড়ি মোটরবাইক নিয়ে আসতে বলেন।

ইতিমধ্যে একটি করাত জোগাড় করে মৃতদেহটি শৌচাগারের মধ্যেই কেটে ছ’টুকরো করেন তিনি। এর পরে সেগুলি বাড়ির বিছানার চাদর ও প্লাস্টিকে মুড়ে রাখেন। জামাই এলে তিনি তাঁকে সব কিছু বলেন। এর পরে রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত তিনি একাই দেহাংশ ব্যাগে পুরে মোটরবাইকে করে লিলুয়ার রানিঝিল, টিকিয়াপাড়া হাইড্র্যান্ট, বাঁধাঘাট, ভট্টনগর ও দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে ফেলে আসেন।

শনিবার হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার অজেয় রানাডে বলেন, “ধৃতেরা খুনের অভিযোগ স্বীকার করেছে। মোটরবাইকটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ধৃতদের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত করাত ও বাকি দেহাংশ উদ্ধারের চেষ্টা করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

menaka biswas murder cctv footage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE