Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
মুম্বইয়ে ভাঙা হাটে গান ধরেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন লোকগানের কদর

থেমে গেল মিহিরলালের ঝুমুর

 চলে গেলেন দরবারি ঝুমুর গানের শিল্পী মিহিরলাল সিংহ দেও। কেন্দা থানার রাজনওয়াগড়ের বাড়িতে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বার্ধক্যজনিত সমস্যায় তিনি ভুগছিলেন।

মিহিরলাল সিংহ দেও। ফাইল চিত্র

মিহিরলাল সিংহ দেও। ফাইল চিত্র

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

চলে গেলেন দরবারি ঝুমুর গানের শিল্পী মিহিরলাল সিংহ দেও। কেন্দা থানার রাজনওয়াগড়ের বাড়িতে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। বার্ধক্যজনিত সমস্যায় তিনি ভুগছিলেন।

পঞ্চকোট রাজবংশের এই উত্তরসূরী আজন্ম সঙ্গীতকেই সঙ্গী করেছিলেন। পুরুলিয়ার মাটির গান ঝুমুরের সঙ্গে তিনি ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতকে মিশিয়ে শ্রোতাদের দরবারি ঝুমুর উপহার দিয়েছিলেন। মিহিরবাবুর দীর্ঘদিনের সঙ্গী বঙ্কিম চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, কানাইলাল সিংহ দেও ও ভাসমঞ্জুরীদেবীর সন্তান মিহিরলালের কিশোর অবস্থায় গানের গলা শুনে জমিদারির ম্যানেজার অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী তাঁকে মাটির গানের চর্চার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ বলেন, বাবার পরামর্শে ও উৎসাহেই তাঁর ঝুমুর চর্চার শুরু।

কানাইলাল সিংহ দেও ছিলেন ঝুমুর গানের পৃষ্ঠপোষক। বাড়িতেই তাঁর নিয়মিত ঝুমুরের আসর বসত। শৈশব থেকেই ঝুমুরের সুর শুনতে শুনতে বড় হয়েছিলেন বলে ঝুমুরের বৃত্ত মিহিরলালকে টেনে নিয়েছিল যৌবনেই। রাজনওয়াগড়ে দেবীপ্রসাদ মেমোরিয়াল হাইস্কুলে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সঙ্গীতচর্চায় মনোনিবেশ করেন। গুরু দুঃখভঞ্জন মহান্তীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিলেও ঝুমুরকেই ভালবেসে ফেলেন তিনি। বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদের প্রয়াগ সম্মেলনে ‘সঙ্গীত প্রভাকর’ উপাধি পেয়েছেন তিনি। তারপরে পেয়েছেন একের পর এক সম্মান।

দীর্ঘদিন তাঁর সান্নিধ্যে কাটানো জেলার লোকগবেষক সুভাষ রায় বলেন, ‘‘তাঁর কাছেই শুনেছি ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন এবং কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে বাংলা সংস্কৃতি উৎসব হয়েছিল। লোকশিল্পী হিসেবে সেই উৎসবে আমন্ত্রিত ছিলেন মিহিরবাবু। কিন্তু ঝুমুর সেই উৎসবে পরিবেশনের তালিকায় না থাকায়, মিহিরবাবুর নাম শিল্পী তালিকায় রাখা হয়নি। তাঁর অনুরোধে উদ্যোক্তারা অনুষ্ঠানের শেষে ১৫ মিনিট তাঁকে গাইতে দিতে রাজি হয়েছিলেন। কার্যত ভাঙা হাটে তিনি গান ধরেছিলেন। শেষ যখন হল, তখন সভাঘর হাততালিতে ফেটে পড়েছিল। তাঁকে আরও ১৫ মিনিট গাইতে সুযোগ দেওয়া হয়। শুনেছি, পণ্ডিত রবিশঙ্কর মিহিরবাবুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন।’’

বেতারে ও দূরদর্শনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন তিনি। সুভাষবাবু জানান, ১৯৯০-র জানুয়ারিতে মুম্বইয়ের দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টের উদ্যোগে একটি অনুষ্ঠানে ঝুমুর পরিবেশন করেছিলেন মিহিরবাবু। তাঁর গাওয়া ঝুমুর মুম্বইয়ের সেই মিউজিয়মে আজও রক্ষিত রয়েছে। শ্রীনিকেতনে তাঁর ঝুমুর শুনে প্রশংসা করেছিলেন শান্তিদেব ঘোষ। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গ-বিহার বিকল্প খরা প্রতিরোধ মঞ্চের হয়ে কাজ করেছেন তিনি। ২০০২ সালে ভাষা শহিদ স্মারক সম্মান পান। ত্রিপুরায় বাংলা সংস্কৃতি পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে লালন পুরস্কারে ভূষিত করেন। কালের প্রেক্ষাপটে ঝুমুর ও স্বরলিপি-সহ কয়েকটি বইও লিখেছেন তিনি।

শেষের দিকে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। যে কন্ঠ তাঁকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সম্মান এনে দিয়েছিল, ইদানীং সেই গলাও ভেঙে গিয়েছিল। ভাল করে কথা বলতে পারতেন না। বঙ্কিমবাবু বলেন, ‘‘মিহিরবাবুর গলায় সমস্যা দেখা গিয়েছিল। তা ছাড়া রাজ্য সরকারের শিল্পী ভাতা বাবদ হাজার খানেক টাকা ছাড়া রোজগার না থাকায় নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটে ভুগছিলেন তিনি। চিকিৎসার খরচের জন্য তথ্য দফতরের কাছে আবেদনও করেছিলেন। তার আগেই চলে গেলেন।’’

মাস দেড়েক আগে স্ত্রী বিয়োগের পরে আরও ভেঙে পড়েন মিহিরবাবু। তাঁর তিনটি সন্তান, দুই কন্যা, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতি নাতনি রয়েছে। এ দিন তাঁর মৃত্যুতে জেলার সংস্কৃতি মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের তরফে তাঁর বাড়িতে গিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাজনওয়াগড়ের মাটিতেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE