গৌতম সান্যাল
বছর চারেক আগে রেল মন্ত্রক থেকে আনার পরেই তাঁকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদ দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর সচিব গৌতম সান্যালের সেই পদোন্নতি হল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। এবং তাঁকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারিই করা হয়েছে।
পদোন্নতি হলেও গৌতমবাবুর বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে আগের মতোই থাকবে বলে প্রশাসনিক সূত্রের খবর। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি এড়িয়ে যে-ভাবে এবং যে-দ্রুততায় এই প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নবান্নের খবর, পদোন্নতির প্রস্তাব থেকে আদেশনামা জারি করা পর্যন্ত গোটা পর্বটি সারা হয়েছে মাত্র তিন ঘণ্টায়! বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতরের তরফে পদোন্নতির আদেশনামা গৌতমবাবুর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
সাধারণ নিয়ম হল, পদোন্নতির প্রস্তাব দেবে কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর। গৌতমবাবুর ক্ষেত্রে কিন্তু তার সমূহ ব্যতিক্রম হয়েছে। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, কর্মিবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর নয়, গৌতমবাবুর পদোন্নতি সংক্রান্ত প্রস্তাবের নোট তৈরি করেছেন খোদ মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। শুধু তা-ই নয়, তিনি নিজেই হাতে করে সেই নোট মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে সই করিয়ে নেন। প্রোমোশন-প্রস্তাবের ওই নোটে মুখ্যসচিব লিখেছেন, দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজের সুবিধের জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। মুখ্যসচিবের নোটে সম্মতি জানাতে দেরি করেননি মুখ্যমন্ত্রী। সম্মতি দিয়ে সে-দিনই আদেশনামা বার করার নির্দেশ দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ফাইল পাঠিয়ে দেওয়া হয় কর্মিবর্গ দফতরে। মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে মেনে বিকেলের মধ্যে তার আদেশনামাও বেরিয়ে যায়।
গৌতমবাবুর পদোন্নতির খবরে প্রশাসনের শীর্ষ মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ওই মহলের একাংশের প্রশ্ন, কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের এক জন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি করা হল কী ভাবে? এই ঘটনা নজিরবিহীন এবং নিয়ম-বহির্ভূত বলেই মনে করছেন তাঁরা। প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তা জানান, ২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে দিল্লি থেকে গৌতমবাবুকে আনার সময় তিনি ছিলেন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার অফিসার। মহাকরণে
এনে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে শুরুতেই প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্যের আইএএস অফিসারদের মধ্যে সেই প্রস্তাবের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাঁরা তদানীন্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষের কাছে গিয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানিয়ে আসেন। সমরবাবুও ওই প্রস্তাবে সায় দেননি। শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর সচিব হিসেবেই কাজে যোগ দেন গৌতমবাবু।
চার বছর আগে এক মুখ্যসচিব সম্মতি দেননি। আর সরকার গঠনের চার বছর পরে বর্তমান মুখ্যসচিবের প্রস্তাব মেনে সেই গৌতমবাবুকেই প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি করা হল। কিন্তু বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে কেন এই পদোন্নতি, সেই প্রশ্নও উঠছে প্রশাসনের অন্দরে। তবে কর্মিবর্গ প্রশাসনিক দফতরের একাংশের বক্তব্য, এই পদোন্নতিতে অনৈতিক কিছু হয়নি। কারণ, কেন্দ্রের যুগ্মসচিব পদে থাকাকালীন গৌতমবাবু এ রাজ্যে আসেন। তখন তিনি প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদে যোগ দিতেই পারতেন। কিন্তু কিছু আমলার আপত্তিতে তা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী এখন সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করলেন।
এই ব্যাখ্যায় জল্পনা অবশ্য থামছে না। প্রশ্ন উঠেছে, কর্মরত অফিসারদের ক্ষেত্রে যে-নিয়ম কার্যকর হয়, অবসরপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে কি তা প্রযোজ্য? এর জবাব নেই কর্মিবর্গ দফতরের কাছে। তারা বলছে, ওই পদোন্নতির নোট কর্মিবর্গ দফতরের বদলে মুখ্যসচিব স্বয়ং তৈরি করেছেন। তাই এর উত্তর তিনিই দিতে পারেন।
তবে প্রশ্ন-জল্পনা ছাড়িয়ে এই পদোন্নতির পিছনে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট দেখছেন নবান্নের কর্তাদের একাংশ। তাঁদের ধারণা, সম্প্রতি কেন্দ্রের সচিব-পদে মনোনয়নের জন্য ১৯৮২ ব্যাচের আইএএস-দের মধ্য থেকে বাছাই পর্ব শেষ হয়েছে। তাতে পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের হেম পাণ্ডের নাম সচিব হিসেবে মনোনীত
হলেও মুখ্যসচিব সঞ্জয়বাবুর নাম বিবেচিত হয়নি। এতে রাজ্য সরকার ক্ষুব্ধ। ঠিক হয়েছে, বঞ্চনার অভিযোগ তুলে পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের অফিসারদের যথাযথ মর্যাদার দাবি জানিয়ে দিল্লির কাছে আবেদন করা হবে। নবান্ন-কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা, এতে মুখ্যসচিবের নাম
দিল্লির কোনও মন্ত্রকের সচিব হিসেবে ফের বিবেচনায় আসতে পারে। দিল্লিতে ওই আবেদন জানানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে গৌতমবাবুর পদোন্নতির আদেশ তড়িঘড়ি ঘোষণার যোগ আছে বলে মনে করছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy