শহর নবদ্বীপ চৈতন্যের জন্যই সারা বাংলার কাছে পরিচিত ছিল। চৈতন্যচরিত কাব্যগুলিতে সে কালের নবদ্বীপের কথা সবিস্তারে লেখা রয়েছে। তারপরেও সাহেবরা নবদ্বীপে গিয়েছেন। তার কিছুটা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ডে’র টানে। কিছুটা চৈতন্যের জন্য। কী এমন অমৃত সুধা রয়েছে এই শহরে, যে মধ্যযুগের বাংলা এত আলো়ড়িত হয়েছিল, সে প্রশ্ন তাঁদের মনেও উঠেছিল। নবদ্বীপে রচিত প্রাচীন পণ্ডিতদের রচনার কথা সংস্কৃত পণ্ডিতদের মুখে মুখে। কিন্তু শহরটির ইতিহাস, অর্থাৎ ওই পণ্ডিতদের জীবনের কথা, পাঠচর্চার কথা তখনও অবহেলিত। চৈতন্যচরিত কাব্যগুলির পরে সাহেবদের কিছু গেজেটিয়ার ধরনের লেখা ছাড়া নবদ্বীপের ইতিহাস লেখা হচ্ছিল না।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় সেই প্রশ্ন উঠল উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরিতে। সেখানে তখন দেখা যেত বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রকেও। বলা বাহুল্য, তাঁদের ঘিরে সেখানে জড়ো হন গুণিজন। ওই নক্ষত্র সমাবেশে নিয়মিত যাতায়াত করেন হুগলির মোক্তার কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী। পেশায় আইনজীবী মানুষটি দেখেন, কত নতুন নতুন পুথি বই নিয়ে লোকে আসছেন। বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের সঙ্গে সে সব নিয়ে আলাপ আলোচনা করছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায় ঘুরে ফিরে কেবল একটি কথায় তাঁদের বলছেন বাঙালির কোনও ইতিহাস নেই। বাঙালির ইতিহাস চাই। শুনতে শুনতে আইন-আদালতের মানুষ কান্তিচন্দ্র ঠিক করলেন তিনিও ইতিহাস লিখবেন। লিখবেন তার জন্মস্থান নবদ্বীপের ইতিহাস।
ব্যাস। খাস নবদ্বীপের মানুষ লিখতে শুরু করলেন শহরের ইতিহাস। আদালতের পাট চুকিয়ে শুরু হল নতুন করে পড়াশোনা। তখন কান্তিচন্দ্রের বয়স তখন চল্লিশ ছুঁইছুঁই। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হল কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর ‘নবদ্বীপ মহিমা’। দেড়শোরও কম পৃষ্ঠা সংখ্যার নবদ্বীপ মহিমাকে বলা হয় নবদ্বীপের উপর ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা প্রথম বই। পণ্ডিতেরা বলেন, আঞ্চলিক ইতিহাসের সর্বপ্রথম বইটি হল ‘ক্ষিতীশ বংশাবলি চরিত’। লেখা হয়েছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের কাছাকাছি সময়ে। এরপর ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিতং’ প্রকাশিত হয়। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার গবেষকেরা মনে করেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের ইতিহাস ছাড়া নবদ্বীপ মহিমার আগে নদিয়া জেলা বা নবদ্বীপ সম্পর্কে আর কোন বই লেখা হয়নি। সেই হিসাবে কান্তিচন্দ্রই প্রথম নবদ্বীপ তথা নদিয়ার আঞ্চলিক ইতিহাস রচনাকার।
এক সময়ে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠে ছিল একশো তিরিশ বছর আগে প্রকাশিত নবদ্বীপ মহিমা। নবদ্বীপ নিয়ে আলোচনায় বারে বারে উঠে আসত বইটির নাম। কিন্তু কোথাও তার হদিস মিলত না। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ বহু চেষ্টায় হারিয়ে যাওয়া নবদ্বীপ মহিমার নষ্ট-কোষ্ঠী উদ্ধার করে কয়েক বছর আগে পরিমার্জন এবং পরিবর্ধন করে প্রকাশ করেছেন। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নবদ্বীপকে বাদ দিয়ে বাংলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকে। অথচ সেই নবদ্বীপকে নিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তাঁদের গ্রন্থে নবদ্বীপকে নিয়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনাটুকু করেছেন মাত্র। কান্তিচন্দ্র তাঁর একক প্রচেষ্টায় নবদ্বীপের ইতিহাস রচনার সূত্রপাত করে ছিলেন। তিনি বলেন, “গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গ নয়। তথ্যের, সাল তারিখের অনেক ভ্রান্তি আছে। কিন্তু ওই বইটি না থাকলে নবদ্বীপের ইতিহাসের যে রূপরেখা টুকু পাচ্ছি তা-ও পাওয়া যেত না। সব থেকে বড় কথা, আজ নবদ্বীপ বা নদিয়া জেলাকে নিয়ে যিনিই কাজ করুন নবদ্বীপ মহিমা হাতে নিয়েই করতে হবে। এখানেই কান্তিচন্দ্রের সাফল্য।”
কান্তিচন্দ্র নিজে নবদ্বীপ মহিমার প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় জানিয়েছেন কী ভাবে অজিতনাথ ন্যায়রত্ন, মহামহোপাধ্যায় ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন, যদুনাথ সার্বভৌম, কৃষ্ণনাথ ন্যায় পঞ্চাননের মতো তৎকালের খ্যাতিমান পণ্ডিত মণ্ডলী তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। ঋণ স্বীকার করেছেন ‘বঙ্গে চৈতন্যচর্চা’, ‘চৈতন্য চরিত্রের’ মতো গ্রন্থ এবং সেকালের বঙ্গদর্শন, বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, শুভকরী পত্রিকার কাছে। ১২৯১, ২১ আশ্বিন হুগলী থেকে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইয়ের প্রথম পাতার উপরে লেখা ছিল নবদ্বীপমহিমা অর্থাৎ নবদ্বীপের প্রাচীন ও আধুনিক বিবরণ। মাঝে লেখকের নাম। নীচে লেখা, সাবিত্রী যন্ত্রে তুলসীদাস সাহা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর তা অত্যন্ত সমাদৃত হয়। উৎসাহিত কান্তিচন্দ্র দ্বিতীয় সংস্করণের প্রস্তুতি শুরু করেন। প্রায় আড়াই গুণ বর্ধিত কলেবর দ্বিতীয় সংস্করণ যখন প্রকাশের পথে সেই সময়ে কান্তিচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৯১৪ সালে। তার বেশ কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে।
নবদ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে সংস্কৃত চর্চার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চা নিয়ে প্রথম আকর গ্রন্থটি রচনা করেন গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ। ইতিহাস বলা হলেও নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস মাত্র। ভুমিকায় গ্রন্থকারের স্বীকারোক্তি, “ইচ্ছা ছিল পূর্ণাবয়ব ইতিহাস লিখিবার। কিন্তু অর্থে এবং সামর্থ্যে কুলাইল না। কত কথা কত স্থানে ছড়াইয়া আছে। কত দুর্লভ সংগ্রহ গত বন্যায় মা গঙ্গা ঘরে ঢুকিয়া ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছেন। এখনও অনেক কিছুই বুকে করিয়া রাখিয়াছি।”
নবদ্বীপের অপর এক কৃতী সন্তান ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি বিজনকুমার মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে গোপেন্দুভূষণ নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার কাজটি শুরু করেন। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত গোপেন্দুভূষণের থেকে সে সময়ে নবদ্বীপের এ কাজে যোগ্য ব্যক্তি কেউ ছিলেন না। নিজে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃত চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার ইতিবৃত্ত তাঁর থেকে ভালো কেই বা জানতেন। মাত্র পঞ্চাশ পাতার বইটি নবদ্বীপের ঐতিহাসিক বিবরণ দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর নবদ্বীপের সংস্কৃত বিদ্যাচর্চার নিখুঁত বিবরণ পাতায় পাতায় তুলে ধরেছেন লেখক। কেমন ছিল সেকালের বিশ্ববিদ্যালয় নগরী নবদ্বীপের পড়াশোনা, পরীক্ষা, পণ্ডিত মশাইয়দের আর্থিক অবস্থা সবই কিছু কিছু করে উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। সেকালের নবদ্বীপের প্রখ্যাত পণ্ডিতদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই ইতিহাস কে সমৃদ্ধ করেছে।
কিন্তু বইয়ের ভুমিকার শেষে গোপেন্দুভূষণ লিখেছিলেন, আমি হয়ত আর সব কিছু শেষ করে যেতে পারব না। কিন্তু দেশের বিদ্যানুরাগী ব্যাক্তিদের নিকট বিনম্র আবেদন তাঁরা যেন এই ইতিহাসটিকে সম্পূর্ণ করেন। কিন্তু পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণের শেষ ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গিয়েছে।
নবদ্বীপের সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস তারপর আর কেউ লেখেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy