দেখতে দেখতে দু’বছর পার। রাজ্যের ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের কর্তাদের পরামর্শ মেলার পরেও হাওড়া জেলায় ছোট ও মাঝারি শিল্পের সম্ভাবনা এখনও সেই তিমিরেই।
এখনও প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে সূচ নিয়ে মান্ধাতা পদ্ধতিতে জরির কাজ করে চলেছেন পুরুষ ও মহিলা কারিগররা। তাঁদের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলছেন ফড়েরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণার পরেও সাঁকরাইলে জরিহাব এখনও অধরা। ডোমজুড়ের বাঁকড়া, নিবড়া, উনসানিতে এখনও বহু মানুষ পুরনো পদ্ধতিতে তৈরি করে চলেছেন রেডিমেড কাপড়। তাঁদের জন্য তৈরি হওয়ার কথা ছিল গারমেন্ট পার্ক। যেখানে তাঁরা উত্পাদন এবং বিপণন সংক্রান্ত যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে পারতেন। উলুবেড়িয়ার হাঁসের পালক দিয়ে তৈরি ব্যাডমিন্টনের শাটল কক তৈরির ব্যবসাও ধুঁকছে।
হাওড়া শহরে কারখানা বাড়ার আর সম্ভাবনা নেই দেখে রাজ্যের ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের কর্তারা দু’বছর আগে জেলা স্তরে শিল্প ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। স্বাধীন শিল্প-সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে সমীক্ষাও চালায় তারা। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং অর্থলগ্নি সংস্থা, বিপণন সংস্থার সঙ্গে কথাও বলে। তারপরেই তারা নিদান দেয়, জেলায় আলু চিপস, কলার চিপস-সহ বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, জরি শিল্প, ব্যাডমিন্টনের শাটল কক শিল্প, রেডিমেড বস্ত্র তৈরি, গয়না তৈরি প্রভৃতি ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। যেগুলি অন্যের উপরে নির্ভর করে না। এ সংক্রান্ত সুপারিশ তারা জেলা শিল্পকেন্দ্রে জমা দেয়। সমীক্ষার রিপোর্ট জমা দেয় ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগম, শিল্প পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম এবং রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কাছেও। কারণ যে সব শিল্প গড়ার সুযোগ রয়েছে, তা বাস্তবায়িত করতে হলে এই সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় লাগবে।
কিন্তু ২০১২ সালের সেই সমীক্ষা থেকে গিয়েছে কাগজে-কলমেই। শিল্পের প্রসারে নেই উদ্যোগ। ব্যবসায়ী এবং বণিকসভাগুলি এ জন্য দুষছেন প্রশাসনিক তত্পরতার অভাবকে। উলুবেড়িয়ার হাঁসের পালক দিয়ে ব্যাডমিন্টনের শাটল কক তৈরির ব্যবসা করেন, এমন এক ব্যবসায়ী বলেন, “এই ব্যবসায় চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারা যাচ্ছে না। চিন থেকে হাঁসের পালক আনা যায়। কিন্তু এ জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের সহায়তা চাই। সেই সহায়তা মেলে না।” বণিকসভাগুলির বক্তব্য: ব্যাঙ্ক-ঋণ, কারখানা গড়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, কারখানার জন্য জমি কিনলে তা দ্রুত মিউটেশন ও চরিত্র বদল করে দেওয়ার মতো কিছু সরকারি সুবিধা সহজে মেলে না।
জেলা শিল্পকেন্দ্রের অবশ্য দাবি, তারা সব সময়েই উদ্যোগীদের পাশে থাকে। বেশ কয়েকটি ক্লাস্টারও তৈরি করা হচ্ছে। যাতে বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগী উপকৃত হন। জেলা শিল্পকেন্দ্রের এক কর্তা বলেন, “ক্লাস্টারের মাধ্যমে শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে গেলে উদ্যোগীদেরও এগিয়ে আসা দরকার। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, শেষ অবধি তাঁরা উত্সাহ ধরে রাখতে পারেননি। মূলধন সংক্রান্ত সমস্যা বা জমি সমস্যা রয়েছে।” তবে, একই সঙ্গে জট কাটিয়ে শিল্প-সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
এক সময়ে হাওড়া শহরকে বলা হত ‘প্রাচ্যের শেফিল্ড’। শহরের ঘরে ঘরে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প। কিন্তু শিল্পের সেই স্বর্ণযুগ এখন শেষ। কোনও মতে টিম টিম করে চলছে কারখানাগুলি। ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের কর্তাদের ধারণা, অন্যের উপরে নির্ভরশীলতাই শহরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের প্রত্যাশিত উন্নতি না হওয়ার মূল কারণ। শহরের এই সব কারখানাগুলি বরাবর নির্ভর করে রেল, প্রতিরক্ষা-সহ বড় বড় শিল্পের উপরে। তাদেরই সহযোগী হিসেবে এক সময়ে গড়ে উঠেছিল এই সব শিল্প। কিন্তু গত কয়েক দশকে রেল, প্রতিরক্ষা দফতর-সহ অন্য বড় কারখানা বরাত কমিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া, অন্য রাজ্যেও এ ধরনের কারখানা গড়ে উঠেছে। তাই হাওড়া শহরে আর ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প বাড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই জানিয়েছেন শিল্প বিশেষজ্ঞরা। আর সেই কারণেই তাঁরা জোর দিয়েছিলেন জেলা স্তরে ছোট ও মাঝারি শিল্পের প্রসারে। কিন্তু তা-ও এখন দূরঅস্ত্।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy