বাগনানের সামতাবেড়েয় এ ভাবেই জমি, গাছপালা তলিয়ে যাচ্ছে রূপনারায়ণে। ছবি: সুব্রত জানা।
বাগনান: কেটে গেল আরও একটি জন্মদিন।
বুধবার সকাল ১০টা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৯ তম জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে বাগনানের সামতাবেড়েয় তাঁরই বাড়িতে। হাজির বিশিষ্ট অতিথি থেকে শরৎপ্রেমী সকলেই। বাজছে সানাই। প্রতিবছর এমন অনুষ্ঠান পালনে কোনও ঘাটতি থাকে না। যদিও প্রতি বছরই দিনটিতে কথাশিল্পীর এই বাসভবনের অস্তিত্ব আর কতদিন, এমন আশঙ্কার কথা মুখে মুখে চর্চিত হয়। আশঙ্কার কারণ, রূপনারায়ণের আগ্রাসী ভাঙন।
কথাশিল্পীর বাড়ির সামনেই বিঘার পর বিঘা জমি। সেখানে লকলক করছে সবুজ ধান। জমির অনেকটাই কথাশিল্পীর নিজের। তাতে কয়েক পুরুষ ধরে ভাগচাষি হিসাবে কাজ করে আসছেন শচীন্দ্রনাথ পতি। এ দিনও কাস্তে হাতে জমির কাজে ব্যস্ত শচীন্দ্রনাথবাবু বললেন, ‘‘প্রতি বছর জন্মদিনে এখানে নানা অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এ বছর কিছুই ভাল লাগছে না। নদী যেন গিলতে আসছে আমাদের। গত এক বছরে শরৎবাবুর প্রায় পাঁচ বিঘা জমি গিলে ফেলেছে রাক্ষুসে রূপনারায়ণ। এ ভাবে চললে খাওয়ার ধানটুকুও আর কপালে জুটবে না।’’ তাঁর হতাশ গলা থেকে বেরিয়ে আসে, “নানা জায়গায় ভাঙন আটকাতে কাজ হয় শুনি। এখানেও তো তা করা যায়। তাতে শরৎবাবুর বাড়ি বাঁচে, আমিও বাঁচি।”
ভাঙনে আতঙ্কিত শরৎচন্দ্র জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির লোকজনও। কমিটির তরফে ভাস্কর রায় বলেন, ‘‘যত দিন যাচ্ছে নদী পাড় ভেঙে ততই এগিয়ে আসছে। অবিলম্বে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আর এখানে অনুষ্ঠান করতে পারব কিনা সন্দেহ আছে।’’ ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে এ দিনই জন্মদিনের অনুষ্ঠান থেকেই গণসাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানান ভাস্করবাবু। বললেন, ‘‘সেচমন্ত্রী-সহ বিভিন্ন মহলে এই গণসাক্ষর সংবলিত দাবিপত্র পাঠানো হবে।’’ আমতার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মিত্রর কথায়, “বহুদিন থেকে আমি সেচ দফতরের কাছে ভাঙন মেরামতের দাবি জানিয়েছি। এটা করা না হলে এই এলাকার একটা বড় জনপদ তো বটেই, শরৎচন্দ্রের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে।’’
সেচ দফতরের অবশ্য দাবি, ভাঙন মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেচ দফতরের কর্তারা জানান, প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে বোল্ডার দিয়ে ১৯০০ মিটার এলাকা জুড়ে নদীর পাড় বাঁধানো হবে। সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বর্ষায় কাজ হলে তা ঠিকভাবে হত না। তাই পুজোর পরে কাজ শুরু হবে।’’
যে নির্মম রূপনায়ারণের নীরব হানাদারিতে আজ অস্তিত্ব সঙ্কটে গোবিন্দপুর, পানিত্রাস, সামতাবেড়ের জমি, বাড়ি। যেখানে কথাশিল্পীর বাড়ি পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেই রূপনারায়ণ ছিল তাঁর কাছে বড়ই প্রিয়। দিদি অনিলাদেবীর বাড়ি ছিল গোবিন্দপুরে। সেখানে যাতায়াতের সূত্রে শরৎচন্দ্র পাশের গ্রাম সামতাবেড়েয় বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ছবির মতো বাগান ঘেরা বাংলো ধরনের এই বাড়িতে জীবনের শেষ বারো বছর কাটিয়েছিলেন তিনি। বাড়ির পশ্চিম দিকের বারান্দা সংলগ্ন লেখার ঘরটির সামনের জানালা ছিল কাচের। লেখার ফাঁকে সেই জানালা দিয়ে সামনে নদীর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন কথাশিল্পী। হয়তো এইভাবেই খুঁজে পেতেন নতুন উপন্যাসের প্লট। নদীপথে তাঁর বাড়িতে আসাযাওয়া ছিল বহু বিপ্লবীর। ইংরেজ পুলিশের রক্তচক্ষু এড়াতে রাতে নদীপথেই উধাও হয়ে যেতেন তাঁরা।
পরবর্তীকালে নদী অনেকটা সরে যায়। জেগে ওঠা চর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে শস্যশ্যামলা। বহু মানুষের জীবনধারণের উপায় হয়ে দাঁড়ায় সেই জমি। কয়েক বিঘা জমি চলে আসে কথাশিল্পীর মালিকানাতেও। কিন্তু ফের দ্রুতগতিতে এবং অতি বিপজ্জনকভাবে আগ্রাসী রূপনারায়ণ। শুধু বিঘার পর বিঘা জমিই যে তলিয়ে যাচ্ছে তা নয়, অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে শরৎচন্দ্রের বাড়ি-সহ কয়েকশো পরিবারও। এ দিন গিয়ে দেখা গেল ভাঙনের টাটকা চিহ্ন। দু’টি নারকেল গাছ সহ মাটির বিশাল চাঙড় চলে গিয়েছে নদীগর্ভে। জেগে আছে নারকেল গাছের ডগার অবশিষ্ট অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy