কাপড়ে জরির নকশা তুলছেন দুই শিল্পী। ছবি: সুব্রত জানা।
সংগঠিত বড় শিল্পে চালু কথা ‘লে অফ’। যার অর্থ, শ্রমিক ছাঁটাই না করে তাঁদের কাজ কমিয়ে দেওয়া। জরিশিল্প সংগঠিত শিল্প নয়। কিন্তু পাঁচশো-হাজারের নোট অচল হওয়ার জেরে হাওড়ার বিখ্যাত এই শিল্পেও ‘লে-অফ’-ছায়ায় শঙ্কায় শিল্পী থেকে মালিক সকলেই। কাজ হারানোর আশঙ্কায় বহু শ্রমিক।
জরিশিল্পের জন্য দেশে প্রসিদ্ধি রয়েছে হাওড়া জেলার পাঁচলার। এখানে ঘরে ঘরে চলে জরির কাজ। অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয়েছে বিয়ের মরশুম। এই সময় ঘরে ঘরে বসে যায় ঢাড্ডা (কাঠের খাটিয়ার মতো একটি খাঁচা)। তাতে কাপড়কে টান টান করে বেঁধে তার উপর তোলা হয় জরির নকশা। প্রতি বছর এই সময় শ্রমিকদের কোলাহলে গম গম করে এলাকার জরিঘরগুলো। তাদের হাতের জাদুতে একে পর এক শাড়ি, লেহঙ্গা, চুন্নিতে জরির কাজে মুগ্ধ হতে হয়।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ ও হাজার টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সেই কোলাহল উধাও। পাঁচলায় নিজের কারখানায় বসে লেহঙ্গার নকশা করছিলেন সেখ ইলিয়াস। বছর পঞ্চাশের ইলিয়াস একজন ওস্তাগর। তাঁর কাছে জনা ১২ কারিগর কাজ করেন। কলকাতার মহাজনের কাছ থেকে বরাত আনেন ইলিয়াস। বরাত পাওয়ার আগে নকশাও অনুমোদন করাতে হয় মহাজনদের কাছে। সেই নকশা মোতাবেক কাজ করে জমা দিলে মহাজন তার দাম দিয়ে দেন। এই ব্যবসায় এটাই দস্তুর। কিন্তু নোট-কাণ্ডের জেরে কাজের গতি কিছুটা রুদ্ধ হয়েছে। ইলিয়াস বলেন, ‘‘আমরা কলকাতার মহাজনের কাছ থেকে বেশি কাজ আনছি না। কারণ, একটা কাজ শেষ করে তার পাওনা আনতে গেলে মহাজন পুরনো নোটেই তা মেটাচ্ছেন। কিছু ২ হাজার টাকার নতুন নোট দিচ্ছেন। সেই টাকা এনে ভাগ বাটোয়ারা করে কারিগরদের দিচ্ছি। কারিগরেরা সমস্যায় পড়েছেন। অনেকে টাকা ভাঙানোর অসুবিধায় মজুরি নিতে চাইছেন না। এ ভাবে কতদিন চলা যায়!’’
তাঁর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের আগে যেখানে সপ্তাহে ৫০ হাজার টাকার কাজ করতাম, সেখানে এখন তা ঠেকেছে ৩০ হাজারে। এই অবস্থায় সব শ্রমিককে কাজ দিতে গিয়ে প্রত্যেকের কাজ কমেছে।’’
পাঁচলারই আর এক ওস্তাগর মদন পাল ইলিয়াসের মতোই রাস্তা নিয়েছেন। নগদ সমস্যায় পড়ে কাজ কমিয়ে দিয়েছেন কারিগরদের। তিনি বলেন, ‘‘কী করে কাজ দেব কারিগরদের। তাঁদের তো পারিশ্রমিক দিতে হবে। যতটুকু না করলে নয় ততটুকু কাজ আনছি। কাউকে বসানো হয়নি। তবে এ ভাবে বেশিদিন চললে কারবার ঝাঁপ ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না।’’
এমনিতেই জরিশিল্পের অবস্থা বছর দুই হল বেশ করুণ। শুধু পাঁচলা নয়, হাওড়ার সাঁকরাইল, উলুবেড়িয়া, বাগনান, উদয়নারায়ণপুর, শ্যামপুর প্রভৃতি এলাকাতেও জরির কাজের উপরে নির্ভরশীল হাজার হাজার মানুষ। ওস্তাগর, কারিগরদের নিজেদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা এবং রফতানির কড়াকড়িতে এই শিল্পের রমরমা আর নেই। তার উপর বহু কারিগর এই শিল্পে এসে যাওয়ায় পারিশ্রমিক কমেছে। রফতানি কমে গেলেও, দেশের বাজারে পাঁচলা তথা হাওড়ার জরিশিল্পীদের কাজের সুনাম আছে। মুম্বই, গুজরাত, দিল্লি প্রভৃতি জায়গায় বিশেষ করে বিয়ের মরশুমে বিপুল চাহিদা থাকে জরির কাজের। এখন চলছে বিয়ের মরশুম। অথচ নোট বদলের সিদ্ধান্তের ধাক্কা সামলাতে শুধু লে অফ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই সাময়িকভাবে ব্যবসা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকে।
নোট-কাণ্ডের জাঁতাকলে পড়ে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় জরিশিল্পের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy