Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গরমের ছুটিতে মিড-ডে মিল বন্ধ, চিন্তায় অভিভাবকেরা

প্যাচপ্যাচে গরমটা উধাও বেশ কয়েক দিন আগেই। জাঙ্গিপাড়ার দক্ষিণডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের এক চিলতে খোলা জায়গায় খানিক জল জমেছিল আগের রাতের বৃষ্টিতে। দুপুরে সেখানেই হুটোপাটি করছিল জনা সাতেক ছেলে।

রান্নাবাটি খেলায় ব্যস্ত খুদে পড়ুয়ার দল। ছবি: দীপঙ্কর দে।

রান্নাবাটি খেলায় ব্যস্ত খুদে পড়ুয়ার দল। ছবি: দীপঙ্কর দে।

প্রকাশ পাল
জাঙ্গিপাড়া শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৬ ০২:২৩
Share: Save:

প্যাচপ্যাচে গরমটা উধাও বেশ কয়েক দিন আগেই। জাঙ্গিপাড়ার দক্ষিণডিহি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের এক চিলতে খোলা জায়গায় খানিক জল জমেছিল আগের রাতের বৃষ্টিতে। দুপুরে সেখানেই হুটোপাটি করছিল জনা সাতেক ছেলে।

প্রচণ্ড গরমের কারণে রাজ্য সরকার ছুটি দিয়েছিল। দুরন্ত শৈশব অবশ্য ঘরে আটকা নেই। ছেলেমেয়েরা স্কুলে থাকলে খেতমজুর পরিবারগুলো নিশ্চিন্তে থাকে। একে পড়াশোনা শিখবে। তার উপর দুপুরের খাবারটা মিলবে। মাঠঘাটে কাজ সেরে বিকেল নাগাদ নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে রান্না চড়ান মা। কিন্তু গরমে টানা এক মাসের ছুটিতে ‘অতিষ্ঠ’ ওরা। একে ছেলেমেয়েদের চোখে চোখে রাখা যায় না। তার উপর প্রতিদি‌ন সময়মতো ওদের মুখে খাবার তুলে দেওয়াও যায় না। স্কুলের মিড ডে মিলই মুশকিল আসান ওঁদের কাছে। কিন্তু ‘অকাল গরমের’ ছুটির পরই ফের গরমের ছুটি বিপাকে ফেলে দিয়েছে তাঁদের। হুগলির জাঙ্গিপাড়া ব্লকের দক্ষিণডিহির অনেকেই তাই চান গরমের ছুটি কমুক।

‘অকাল গরমের’ ছুটি শেষে তিন দিন স্কুল হয়ে আজ থেকে ফের ছুটি পড়ে যাচ্ছে স্কুল।

দক্ষিণডিহি ক‌লোনি, পালপাড়ার অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। পরের জমিতে দিনমজুরি করে অনেকের দিন চলে। শনিবার দুপুরে দক্ষিণডিহি পালপাড়ায় সঞ্জিৎ মাঝির মাটির বাড়িতে হঠাৎই হাজির এই প্রতিবেদক। বাড়ি বলতে ছোট্ট একটা ঘর আর এক ফালি বারান্দা। সেখানেই তিন ছেলে নিয়ে দম্পতির সংসার। প্রায় ভেঙে পড়া ঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে বসতে দেন সঞ্জিৎবাবুর স্ত্রী শ্যামল‌ী। কথায় কথায় জানালেন, বড় ছেলে পঞ্চা মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরোয়নি। বছর কয়েক আগে মাধ্যমিকে চারটে বিষয় পরীক্ষা দিয়ে আর দেয়নি। সংসারের জন্য সোনা-রুপোর কাজ করতে পাড়ি জমায় হায়দরাবাদে। সঙ্গে যায় মেজ ভাই আদিত্য। ছোটটা শিশুশ্রেণিতে পড়ে। শ্যামলীদেবীর কথায়, ‘‘স্বামী পরের জমিতে কাজ করে। সকালে কাজে বেরিয়ে যায়। আমাকে গরু চরাতে হয়। ছেলেটা স্কুলে থাকলে নিশ্চিন্তে থাকি। ওখানে মিড-ডে-মিল খেয়ে আসে। কাজ সেরে ফিরে আমরা নিজেদের জন্য দু’টো ফুটিয়ে নিই। এখন ছেলের জন্য আগে রান্না করতে হচ্ছে।’’ মায়ের পাশ থেকে খুদে পড়ুয়া জানায়, ‘‘স্কুলের খাবার খুব ভাল লাগে। পেট ভরে খাই।’’

দিন কয়েক আগে পঞ্চা এবং সুব্রত বাড়ি এসেছে। পঞ্চার কথায়, ‘‘যখন স্কুলে পড়তাম তখন মিড-ডে-মিলের বালাই ছিল না। থাকলে বহু ছেলে স্কুলছুট হত না। মেয়েরা যেমন কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে, ছেলেদের মধ্যেও স্কুলছুট রুখতে এমন কোনও প্রকল্প থাকা জরুরি। তা হলে হয়তো অনেককেই রোজগারের জন্য ভিন্ রাজ্যে যেতে হবে না।’’ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রতিবন্ধী সুজয় মাঝি। সুজয় বলেন, ‘‘কাজ করতে পারি না। বাবা-মায়ের সামান্য আয়ে সংসার চলে। মেয়ে রূপসা প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আমরা বাড়িতে নজর দিতে পারি না। স্কুলে থাকলে তবু পড়াশোনা শিখতে পারে। এত দিন ছুটি থাকলে খুবই অসুবিধা হয়। তা ছাড়া স্কুলে পেট ভরে মিড ডে মিলটাও পায়।

মিড-ডে-মিলের খাবার যে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝেন জাঙ্গিপাড়া ব্লকের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা। নিলারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের আশপাশে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। মাঠেঘাটে কাজ করেন। প্রধান শিক্ষক গৌতমকুমার বালি বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে অষ্টম নয়, দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেমেয়েরাও মিড-ডে-মিল খায়। এক বার নবম-দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের মিড-ডে-মিল বন্ধ করে দেওয়ায় অভিভাবকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। এখানকার ছেলেমেয়েদের জন্য মিড-ডে-মিল কতটা জরুরি ভাবতে পারবেন না। এর জন্য স্কুলছুটের সংখ্যাও অনেক কমে গিয়েছে।’’ একই বক্তব্য আঁটপুরের একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারের নির্দেশ মানা ছাড়া তো গতি নেই। কিন্তু এ তল্লাটে মিড-ডে-মিলের ভূমিকা অপরিসীম। মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই দিব্যি স্কুল খোলা যেত। তা না করায় যেমন পড়াশোনার ক্ষতি হল। তেমনই মিড-ডে-মিল থেকেও ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হল।’’

হুগলির প্রত্যন্ত এই ব্লকের বহু বিদ্যা‌লয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই গলায় শোনা গিয়েছে এরই প্রতিধ্বনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mid Day meal Parents school
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE