ঘটনার পরে দু’দিন কেটে গেলেও খানাকুলের হিরাপুর গ্রামে তৃণমূল কর্মী আহম্মদ আলি আখুনকে খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত, ওই দলেরই নেতা মোকারম হোসেনকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এক জন বাদে ধরা পড়েনি বাকি অভিযুক্তেরাও। পুলিশ জানিয়েছে, ধৃতদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। তবে, মোকারম সোমবার দাবি করেছেন, খুনের ঘটনায় তাঁর নাম মিথ্যা জড়ানো হয়েছে।
শনিবার রাতে আরামবাগে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময় বাড়ির কিছুটা দূরে আহম্মদ আলি নামে ওই প্রৌঢ় তৃণমূল কর্মীকে বাঁশ, মুগুর দিয়ে পিটিয়ে খুন করা হয়। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মোকারম এবং তাঁর ৮ অনুগামীর বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। নিহতের পরিবারের লোকজন এবং তাঁদের পড়শিদের অভিযোগ, মোকারমের নানা অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করার জন্যই আহম্মদ আলিকে খুন করা হয়। রবিবার দুপুরে খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে শেখ আরেফুল নামে এক তৃণমূল কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ধৃতকে সোমবার আরামবাগ আদালতে হাজির করানো হয়। পুলিশ তাঁকে তিন দিন নিজেদের হেফাজতে রাখার আবেদন জানায়। বিচারক সেই আবেদন মঞ্জুর করেছে।
রবিবার চেষ্টা করেও মোকারমের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে, সোমবার তিনি খুনের অভিযোগ উড়িয়ে ফোনে দাবি করেন, ‘‘দিন চারেক আমি এলাকাতেই নেই। খুনের ঘটনায় মিথ্যা আমাকে জড়ানো হয়েছে। এলাকায় এক মহিলার সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে আহম্মদ আলি খুন হন বলে শুনেছি।’’
মোকারমের এই দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছেন আহম্মদ আলির বাড়ির লোকজন এবং পড়শিরাও। এ দিনও তাঁরা মোকারমের বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগে অনড় থাকেন। তাঁদের দাবি, নিজেকে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি দাবি করে মোকারম গ্রাম্য বিবাদ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে মাতব্বরি করছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে পর্যন্ত মোকারম কলকাতায় দর্জির কাজ করলেও রাজ্যে পালাবদলের পর থেকে তিনি আর কলকাতায় যাননি। পুরোপুরি রাজনীতিতেই জড়িয়ে পড়েন। খানাকুলের বিধায়ক ইকবাল আহমেদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকেদের সঙ্গে প্রায়ই মোকারমকে দেখা যেত বলে অনেকেই তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস করতেন না। তবে, মোকারমের মাতব্বরি মেনে নিতে পারেননি দলের পুরনো কর্মী আহম্মদ আলি। প্রতিবাদ করতেন। গ্রামবাসীদের অনেকেই তাঁকে সমর্থন করছিলেন। এর ফলে, মোকারমের গুরুত্ব ক্রমশ কমছিল। নিজের এলাকার পঞ্চায়েত অফিসেও তিনি ঢুকতে পারছিলেন না। সেই আক্রোশেই তিনি আহম্মদ আলিকে সরিয়ে দেন বলে অভিযোগ।
মোকারম দাবি করেছেন, দলের পক্ষ থেকেই তাঁকে অঞ্চল সভাপতি পদে বসানো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কিশোরপুর-১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তথা অঞ্চল তৃণমূলের কার্যকরী যুব সভাপতি নুর নবি মণ্ডল বলেন, ‘‘মোকারম স্বঘোষিত নেতা। আমরা ওঁকে দলের অঞ্চল সভাপতি হিসেবে কেউ জানি না। দল থেকেও সে রকম কোনও বার্তা দেওয়া হয়নি।’’ বিধায়ক ইকবাল আহমেদ রবিবারেই দাবি করেছিলেন, মোকারমকে তিনি চেনেন না।
এই খুনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ নিচুতলার তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কবে বন্ধ হবে, সে প্রশ্নও তুলছেন তাঁদের কেউ কেউ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার জন্য বারবার সতর্ক করলেও আরামবাগ মহকুমায় সেই নির্দেশই সার বলে মনে করছেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ। গত বছর মে মাসেই গোঘাটের মামুদপুর গ্রামে দলের গোষ্ঠী-সংঘর্ষে নরেশ রায় নামে এক প্রৌঢ় নেতা মারা যান। আহত হন ৫ জন। পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে, মহকুমার চারটি থানায় (গোঘাট, আরামবাগ, খানাকুল এবং পুড়শুড়া) গত তিন বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই তৃণমূলের গোষ্ঠী-কোন্দলের জেরে সাধারণ ডায়েরি বা এফআইআর হচ্ছে গড়ে তিন-চারটি। মহকুমার ৬৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে অন্তত ৫০টিতে উন্নয়নের কাজ এবং পরিকল্পনা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে ব্যাহত হচ্ছে বলে মেনেও নিয়েছেন দলের নেতাদের অনেকেই।
কেন এত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের নেতাদের অনেকেই বলছেন, প্রভাব বিস্তার বা ক্ষমতা দখলই এর কারণ। তবে, হুগলিতে দলে কোনও বিভাজন নেই দাবি করেও তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘পুরনোরা নতুনদের মানতে চাইছেন না। আবার নতুনরাও পুরনোদের সম্মান দিচ্ছেন না বা পরামর্শ নিচ্ছেন না। দলের জন্য যা ভাল সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সিদ্ধান্ত যাঁরা মানতে পারবেন না, তাঁদের দলে থাকার দরকার নেই। এ রকম ঘটনাগুলিতে আমরা নজর রাখছি। নেত্রীর নির্দেশ মতো কড়া পদক্ষেপ করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy