কোলিয়া ঘোষপুরে শোকার্ত পরিবার। ছবি: সুব্রত জানা।
মন্দিরের পাশে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া নারকেল গাছটা জানান দিচ্ছিল মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ছবিটা। হাওড়ার শ্যামপুরের কোলিয়া ঘোষপুরে মন্দিরের কাছেই শ্মশান। ১০০ দিনের প্রকল্পে শ্মশানে আসার রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হয় এক সপ্তাহ আগে। তাতেই কাজ করছিলেন কোলিয়া ঘোষপুর ও পাশের গ্রামের দ্বীপচাঁদপুরের ৯ জন হতভাগ্য। স্থানীয় বালিজাতুরি পঞ্চায়েতের প্রধান সঞ্জয় মাঝি বার বার নিজেকেই ‘দোষ’ দিচ্ছিলেন। বললেন, “কয়েকদিন আগে ওরাই একটা বড় প্রকল্পে কাজ করেছিল। ওই প্রকল্পের কিছু টাকা বেঁচে গিয়েছিল। তাই ওদের নিয়েই শ্মশানে আসার রাস্তার কাজে হাত দিয়েছিলাম। এমনটা যে ঘটবে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। পরিবারগুলোর বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল।”
বছর দু’য়েক আগে ২০১২ সালের এপ্রিলে উদয়নারায়ণপুরে একই ভাবে বাজ পড়ে একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন নয় জন। তখন সেইসব পরিবারের কথা ভেবে আকুল হয়েছিলেন ঘোষপুর, দ্বীপচাঁদপুরের মানুষ। স্বপ্নেও ভাবেননি, একজিন তাঁদের শোকেও আকুল হবেন অন্যরা।
বৃহস্পতিবার দুপুরের ঘটনার পরে এলাকা গেলে কান্নার রোল ছাড়া আর কিছু কানে ঢোকেনি। মন্দিরের কাছে ভিড় করেছিলেন গ্রামের মানুষ। সকলেই শোকে পাথর। চুপ করে থেকে যেন শোকের তীব্রতা মাপার চেষ্টা করছেন সকলে। হাত কয়েক দূরেই ৯ জনের মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে গাছটা। যার কাছে মন্দিরের বারান্দায় বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচাতে ঠাঁই নিয়েছিলেন ৯ জন হতভাগ্য। বেশিরভাগ নিহতই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। এই অবস্থায় কী ভাবে বাঁচবেন তাঁরা তা নিয়ে পরিবারগুলির পাশাপাশি ভেবে পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষ। এক লপ্তে যেন শূন্যতা নেমে এসেছে গোটা এলাকায়।
উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে আহতদের দেখতে এলেন মন্ত্রী অরূপ রায়। ছবি: সুব্রত জানা।
৫৫ বছরের নির্মল সাঁতরার কথাই ধরা যাক। নাবালক তিন ছেলে, স্ত্রী রয়েছেন। তিনি ছিলেন একমাত্র রোজগেরে। পেশায় দিনমজুর নির্মল সুযোগ পেলে ১০০ দিনের প্রকল্পেও কাজ করতেন। স্ত্রী দুর্গাদেবী বললেন, “সকালে উঠেই কাজে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ১০টার সময় বাড়িতে এসে খাবার খেয়ে ফের চলে যান। বাজের শব্দ শুনেছিলাম। কিন্তু তা যে স্বামীকে কেড়ে নেবে তা কে জানত। পরে পাড়ার লোকের মুখে শুনলাম মন্দিরের কাছে বাজ পড়েছে। স্বামী আর নেই। আমার এমন সর্বনাশ কেন হল বলতে পারেন।’’ কান্নায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন দুর্গাদেবী। টালির ছাউনি দেওয়া ইটের দেওয়ালের ঘর। তবে কালান্তর বাজ কেড়ে নিয়েছে নির্মলবাবুর ভাই বছর ষাটের বিমল সাঁতরাকেও। তাঁর তিন ছেলে সামান্য হলেও রোজগার করেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তিন ছেলের রোজগারও সংসারে টানাটানি বন্ধ করতে পারেনি। ফলে বাড়িতে বসে থাকতে পারতেন না বিমলবাবু। বড় ছেলে দীনবন্ধু বললেন, ‘‘সুযোগ পেলেই বাবা কাজে বেরিয়ে পড়ত। বারণ করলেও শুনত না। বলত, সংসারে কিছুটা বাড়তি টাকা এলে সংসারটা বাঁচবে। কিন্তু তার জন্য এমন পরিণতি, ভাবতেও পারছি না।’’
পাশের গ্রাম দ্বীপচাঁদপুরের শৈলেন সরদারের বাড়িতেও একই ছবি। বছর পঁয়তাল্লিশের শৈলেনবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবীকে ঘিরে রয়েছেন পাড়ার মহিলারা। আট ও চার বছরের দু’টি নাবালক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার পেশায় দিনমজুর শৈলেনবাবুর। স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়েকে নিয়ে কী ভাবে বাঁচবেন তা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন সরস্বতীদেবী। মৃতদের মধ্যে সাতজন ঘোষপুরেরই বাসিন্দা। বাকি দু’জন দ্বীপচাঁদপুরের। গ্রাম থেকে ফেরার পথে ঘোষপুর শ্মশানে দেখা গেল এই গ্রামের সাতজন মৃতের চিতা সার দিয়ে সাজানো। গত সাতদিন ধরে যে শ্মশানের সংস্কারই করছিলেন তাঁরা।
বছর দু’য়েক আগে ২০১২ সালের এপ্রিলে উদয়নারায়ণপুরে একই ভাবে বাজ পড়ে একসঙ্গে মারা গিয়েছিলেন কয়েকজন। তখন সেইসব পরিবারের কথা ভেবে আকুল হয়েছিলেন ঘোষপুর, দ্বীপচাঁদপুরের মানুষ। স্বপ্নেও ভাবেননি, একজিন তাঁদের শোকেও আকুল হবেন অন্যরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy