কেমন ভাবে চলে সিন্ডিকেট?
শোনা যাক সেই অনাবাসী বাঙালির কথা, সাড়ে তিন বছর আগে রাজারহাটে আধ একর জমি কিনে যিনি ঘরে ফেরার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এত দিনে বাড়ি তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এখনও প্রকল্পের একটি ইটও গাঁথা হয়নি! অভিযোগ, বাড়ি তৈরির কাজ শুরুর মুখেই স্থানীয় তোলাবাজরা পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করে। বিষয়টি মিটিয়ে নিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তিনি। তাতে ফল না হওয়ায় পুরো টাকা যথাস্থানে মিটিয়ে দিতে হয়েছে।
তার পরেও সমস্যা মেটেনি! এক দল স্থানীয় বাসিন্দা দাবি করেন, জমির টাকা বাবদ আরও পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে হবে। অনাবাসী ওই ভদ্রলোক জমি কিনেছিলেন হিডকো-র কাছ থেকে। তাই এমন দাবি শুনে আশ্চর্য হয়ে যান! তবু এ বারেও টাকা দিয়েই মেটাতে হয় সমস্যা। এখানেও শেষ নয়। এ বারে দাবি আসে, স্থানীয় জোগানদারদের থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিতে হবে। চেয়েছিলেন, ‘রেডিমিক্স কংক্রিট’ দিয়ে নির্মাণ করতে। সেই পরিকল্পনা বাতিল করে এখন স্থানীয়দের থেকে ইট-বালি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। নতুন বাড়ির স্বপ্ন নিয়ে গত তিন বছরে বিদেশ থেকে কলকাতায় এসেছেন বারো বার! তবু এখনও হাল ছাড়তে নারাজ তিনি। আশা, কিছু দিনের মধ্যেই বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করতে পারবেন।
সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন
অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ও এনজিসি-র কথা।
২০০৮ সালের অগস্ট মাস থেকে রাজারহাট এক্সপ্রেসওয়ের ধারে যাত্রাগাছি মৌজায় সাড়ে ছ’একর জমির উপর ‘গ্রিন বিল্ডিং’ বা পরিবেশ-বন্ধু বাড়ি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। ৩৩৯ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ ২০১১ সালে সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ভিত গড়ার শুরুতেই সমস্যার সূত্রপাত। প্রকল্প-লাগোয়া মৌজা নবাবপুরের একটি সংস্থা থেকে ‘রেডিমিক্স কংক্রিট’ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় জোগানদারেরা। অভিযোগ, লাগাতার হুমকি ও গন্ডগোলের জেরে প্রকল্পের কাজ ছেড়ে পালিয়ে যান শ্রমিকরা। নিউটাউন থানায় এ বিষয়ে অভিযোগও দায়ের করে ওএনজিসি। পরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ গতি হারায়। ২০১৩ সালে এই বাড়ি সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আজও কাজ চলছে!
বাম আমলে রাজারহাট উপনগরী তৈরির হাত ধরেই রাজ্যে সিন্ডিকেট ব্যবসার সূত্রপাত। তখন জমিহারাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই ছিল সিন্ডিকেটের লক্ষ্য। দিন বদলের সঙ্গে চরিত্র বদলেছে সিন্ডিকেটের। ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের আড়ালে এলাকার দখলদারিই মূল হয়ে ওঠে বহু জায়গায়। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, বাম আমলের শেষের দিকে সিন্ডিকেট-সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত গৌর, রুইস মণ্ডল-সহ কয়েক জনের হাতে।
সেই নামগুলো এখনও আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সইফুল, ভজাই, মুনিয়া, আফতাবউদ্দিন, শিবু-সহ বেশ কিছু নাম। স্থানীয় সূত্রের খবর, পালাবদলের রাজারহাটে প্রায় প্রথম থেকেই শাসক দলের কোন-না-কোনও নেতানেত্রীর অনুগামী হয়ে শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায় রুইস, ভজারা। ফলে সিন্ডিকেট ব্যবসার পাশাপাশি এলাকা দখলের লক্ষ্যেও শুরু হয়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষ। তার বলি হন কেষ্টপুরের স্বপন মণ্ডল। ২০১১-এর নভেম্বরের এক সকালে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা। এই হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরেই সিন্ডিকেট ব্যবসার রমরমার কথা প্রকাশ্যে চলে আসে। আর এই ব্যবসায় তৃণমূলের স্থানীয় সাংসদ এবং স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর পরোক্ষ মদত থাকার অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
পরিস্থিতি বদলায় ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজারহাটে তৃণমূলের জয়ের পর থেকে। দলীয় সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত ভোটের পরে রাজারহাটের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয় বিধায়কের অনুগামীরা। ভজাই, সইফুলরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তুলনায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে সাংসদের অনুগামী আফতাবউদ্দিন, রাজীব দাসরা। সিন্ডিকেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও চলে যায় ভজাইদের হাতে।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত লোকসভা নির্বাচনের আগে জেল থেকে ছাড়া পায় রুইস মণ্ডল। তাকে কে নেবে, তা নিয়ে শুরুতে দুই শিবিরের মধ্যে রীতিমত ‘টাগ অব ওয়ার’ চলে! শেষ পর্যন্ত সাংসদ-শিবিরেই তাকে দেখা যায়। রুইস এলাকায় ফিরতেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে সাংসদের অনুগামীরা। তৃণমূলের এক নেতা জানান, লোকসভা ভোটে স্থানীয় বিধায়কের সাহায্য ছাড়াই রাজারহাট-নিউটাউনে ১৬ হাজারেরও বেশি ভোট এগিয়ে ছিলেন কাকলিদেবী। এতে বাড়তি অক্সিজেন পায় তাঁর অনুগামীরা। তার পর থেকেই দু’পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। বিশেষত বালিগুড়ি, মহিষবাথান, ঠাকুরদারি, নবাবপুরযেখানে বিধায়ক-শিবিরে প্রাধান্য বেশি ছিল, সেখানেই এলাকা দখল নিয়ে গোলমাল শুরু হয়।
শনিবারের ঘটনাও তার প্রতিফলন বলে অভিযোগ। যে সিন্ডিকেটকে ঘিরে এ দিনের ঘটনা, তা ছিল বিধায়কের অনুগামী বলে পরিচিত ভজাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। সিন্ডিকেটটি দখলে নিতে ভোটের পর থেকেই সেখানে ভিড় বাড়াতে থাকেন সাংসদের অনুগামীরা। ফলে দুই শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যদিও বিধায়ক ও সাংসদ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দুই গোষ্ঠীর সমর্থকেরা সিন্ডিকেটের দখল নিয়ে ঝামেলার কথা মানেননি। পুলিশ কর্তা সন্তোষ নিম্বলকর বলেন, ‘‘নিউটাউনে সিন্ডিকেটের ঝামেলা নেই। আছে রাজারহাটের দিকে।’’
রাজারহাটের সিন্ডিকেট-ব্যবসা নিয়ে বছর তিনেক আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বপন মণ্ডলের হত্যার পর দলীয় নেতৃত্ব ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছিলেন, তৃণমূলের পরিচিত কেউ সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত থাকতে পারবেন না। কেউ সিন্ডিকেট, প্রোমোটারি ব্যবসায় যুক্ত থাকলে তাঁকে দল ছাড়তে হবে। ২০১৩-র এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সিন্ডিকেট ব্যবসা। কিন্তু এর নামে জবরদস্তি চলবে না।
আজকের ঘটনায় প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠছে কেন? কোনও তরফ থেকেই সদুত্তর মেলেনি। বরং এ দিনও নব্য শহরের বাসিন্দারা সাতসকালে ঘুম ভেঙে দেখলেন সিন্ডিকেটের ‘দখল’ নিয়ে দুই শিবিরের অনুগামীদের তাণ্ডব, পুলিশের তাড়া, র্যাফের লাঠিপেটার দৃশ্য!