ছিন্নমূল: ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান থেকে ভারতমুখী উদ্বাস্তুস্রোত।
এমনই এক বসন্তপূর্ণিমা তিথি, দোলফাগুনের দিন, এক নবজাত বাংলা পত্রিকায় সম্পাদকীয়-র শিরোনামটি বহু বাঙালির মনোযোগ টেনে নিল: ‘ফাল্গুনীপূর্ণিমা’। আবির্ভাবের জন্য কেন এমন একটা লগ্ন বেছে নেওয়া, তারই যুক্তি উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সম্পাদকীয়টির বিবিধ অনুচ্ছেদে। মন্দ্র, স্পষ্ট স্বীকারোক্তি: “কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি বৌদ্ধ, কি খৃষ্টান— সকলের প্রতিই যাঁহার সমান প্রেম, সকলের পরিত্রাণের জন্যই যিনি সমান ভাবে প্রেমভক্তির মহামন্ত্র প্রচার করিয়াছেন— ধনী দরিদ্র মহৎ ক্ষুদ্র কেহই যাঁহার করুণায় বঞ্চিত হয় নাই, আজ আমাদের সেই গৌরাঙ্গসুন্দরের আবির্ভাবের দিন।” সে দিনের অনেক পত্রিকার ভিড়েও আনন্দবাজার পত্রিকা দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার বিশিষ্ট বাঙালি চরিত্রের কারণে। সে যেন এসে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘ পথ হাঁটার প্রস্তুতি নিয়ে: বেশ উঁচু তারে বাঁধা তার লক্ষ্য, বহু দূর পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত তার দৃষ্টি। দোলের উচ্ছ্বাসের মধ্যে প্রথম দিনেই আলতো করে ছড়িয়ে দেওয়া হল রাজনীতির কুঙ্কুমচূর্ণ, আর সমাজের প্রতি অঙ্গীকারের আবির। প্রথম সংখ্যায় ‘দোল’ শীর্ষক সম্পাদকীয়টি বিশেষ স্মরণীয়: “এই নবযুগের প্রভাতে বিশ্বমানব হোলিখেলায় উন্মত্ত। আয়ার্ল্যান্ড, ঈজিপ্ট, ভারতবর্ষ, পৃথিবীর সর্বত্র নবযুগের এই হোলিখেলা আরম্ভ হইয়াছে। পিচকারী এ খেলায় নাই, কিন্তু আছে এক পক্ষের প্রবলের ঔদ্ধত্য ও ক্ষমতালিপ্সা... অন্য দিকে মুক্তিকামীর অদম্য ইচ্ছা, স্পষ্ট সঙ্কল্প।” মহাপরাক্রান্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন তিন মহাদেশের তিনটি দেশের নামের উচ্চারণ নিমেষে বুঝিয়ে দেয়, কোন ‘হোলিখেলা’র দিকে চোখ রেখে দোলফাগুনের যাত্রা শুরু সে দিন।
আজ সেই পুরনো কাগজ টেনে পড়তে গিয়ে মনে হয়, ভাষা-সমৃদ্ধ আর কল্পনাশিল্পী বাঙালির পক্ষেই সম্ভব দোলের দিনটিকে বেছে নিয়ে এই ভাবে তাকে বিশেষ করে তোলা— বাংলার জন্য, ভারতের জন্য, পরাধীন পরিবেশে স্বাধীনতার স্বপ্নের জন্য, ক্ষমতাহীনের আত্মশক্তি জাগানোর জন্য। কিন্তু পাঠক যদি জানতে চান কেমন হল সেই যাত্রা, কোথায় এসে পৌঁছোনো গেল, সেখানেই কি পৌঁছতে চাওয়া হয়েছিল?
যে দিন সত্যিই ‘হোলিখেলা’র শেষে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছল স্বাধীনতা, সে দিনটি তো খুব এক শুভক্ষণ ছিল না। মধ্যরাত্রের স্বাধীনতা লাভ ‘সমান প্রেমভক্তি’র আবহে ঘটল না। দেশ দুই ভাগে বিদীর্ণ হওয়ার মুহূর্তে ‘সকলের পরিত্রাণ’-এর কথা বলাটাও যেন তখন ঘোর পাপের মতো শোনায়। তবু ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট বিধ্বস্ত ব্যথিত বাঙালি মানসও যখন মুক্তির আনন্দের স্বাদ পেতে উন্মুখ, নিশ্চয়ই কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিক-লেখকরা।
কী লেখা হল পনেরো ও ষোলো অগস্টের আনন্দবাজারে? নানা কারণেই ইতিহাস-পাঠকের কাছে এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও সংঘর্ষের ফলে ত্রস্ত বাংলায় তার আগের কয়েক মাস ধরে বয়ে গিয়েছে একটা অস্বাভাবিক হাওয়া। দেশভাগই বাঞ্ছিত এমন পরিস্থিতিতে— মনে করেছে বাঙালি সমাজের এক বড় স্রোত, এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আনন্দবাজারও।
কিন্তু দেশভাগ কী ভবিষ্যতের বার্তা বয়ে আনছে, তাই ভেবে ভীতি ও আশঙ্কাও থেমে থাকেনি। শুধু যে বহু মানুষ দেশচ্যুত হয়ে অন্য দেশের বাসিন্দা হয়ে যাবেন, তা-ই নয়, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটিকে নিয়ে এত রাজনীতি হয়ে গিয়েছে তার আগের কিছু বছর যে, ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে ভিন্দেশে যে বাঙালিরা থেকে যাবেন— তাঁদের নিয়ে আশঙ্কা তখন বিরাট। অথচ ধর্মপরিচয়কে ছাপিয়ে নতুন দেশের জাতীয় সত্তা তৈরি করার স্বপ্নও কম প্রবল নয়। সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশ: পঞ্জাবকে বাদ দিলে গোটা ভারতে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন ও বিপর্যস্ত তখন বাঙালি সত্তাটিই। বস্তুত এমন সময় ইতিহাসে কম এসেছে (আদৌ আর এসেছে কি?) যখন দুনিয়াময় সবচেয়ে বড় দুর্বিপাকের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই বঙ্গভূমি। বাঙালির অন্যতম প্রধান সংবাদ-বাহক পত্রিকা কী বলছিল সেই সন্ধিক্ষণের ওলটপালটের মধ্যে দাঁড়িয়ে?
বলছিল, “সুদীর্ঘ তপস্যার পর জাতির জীবনে পরম আবির্ভাবের মতোই আজ সমাগত ১৫ই আগষ্ট। অনাগত ভবিষ্যতে, সুপ্রাচীন ভারতের বহু বিচিত্র ইতিহাসে উত্থানপতনের, রাজ্য, সাম্রাজ্য ও শাসনতন্ত্রের ভাঙা-গড়ার একটি নীরব সাক্ষিরূপে স্মরণীয় হইয়া রহিবে ১৫ই আগষ্ট।” লক্ষণীয়, একটা বিরাট মাপের ঘটনা ঘটে গেলে অনেক সময় সেই দিনটাতেই যেন তার যথার্থ ও সম্পূর্ণ উপলব্ধি হয় না। কিন্তু না, ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগ দিবসটির ‘স্বাধীনতা’ অংশটির ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি। বহু-প্রতীক্ষিত, বরং একটু বিলম্বিত আগমনই বটে এই দিনটির, অনেক দিনের প্রতীক্ষা হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে। তাই একেবারে নতুন কলেবরে ভারতবর্ষ যে নির্মিত হল, অতীত সাম্রাজ্য বা শাসনতন্ত্রের একাদিক্রম পর্বের মতোই এটি আর যে এক বিরাট পর্বের আরম্ভ, সে উচ্চারণ ছিল স্পষ্ট।
কিন্তু ওই দিনটির মধ্যে কলঙ্কের মতো মিশে রইল যে ‘দেশভাগ’, তাকে এড়িয়ে আনন্দসুর বাজানো অসম্ভব। “যে দিনটিকে ধ্রুবতারার মতো লক্ষ্য করিয়া জাতি একদা যাত্রা শুরু করিয়াছিল, নব নব গতিপথের সন্ধান করিয়াছিল, ...সেই দিনটির বহু-প্রত্যাশিত প্রত্যূষ আজ ১৫ই আগষ্টে আমরা প্রত্যক্ষ করিলাম ভিন্ন মূর্তিতে, অপ্রত্যাশিত রূপে।” দেখা হয়েছিল এক “এক অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন”— কিন্তু তা পূর্ণ হল না। কার দায় সেটা? “আজ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে ভেদ-বিদ্বেষের বিষাক্ত ছুরিকাঘাতে দ্বিধাখণ্ডিত,” লেখা হল।
এই জায়গায় এসে আমরা দেখি, কোনও হিন্দু-মুসলিম উচ্চারণ নেই— যেন বাস্তবের সঙ্গে সজোর ধাক্কা খেয়ে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে নিচ্ছে তার পরবর্তী অবস্থান। সত্তা-সংঘর্ষের কাহিনি, অনেক পথ বেয়ে চলা সামাজিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস এ বার খুঁজে নিচ্ছে নিজেকে পুনর্নির্মাণের পথ। বাইরের শক্তিই যদি আমাদের দ্বিখণ্ডিত করে দেয়, কী ভাবেই বা এক থাকব আমরা? — এই মর্মে অতঃপর যে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস লেখা হবে, পনেরো অগস্ট আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তেই তার প্রথম দৃষ্টান্ত আমরা পড়ে ফেলতে পারি। তাই এই সম্পাদকীয়টিকে বলা যায়, স্বাধীনতা-পূর্ব জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর জাতীয়তাবাদের এক অসাধারণ সন্ধিসূত্র। একটা বিরাট ঐতিহাসিক দায়কে পিছনে ফেলে নতুন করে ভারত তৈরি করার বিশ্বাস-উদ্দীপ্ত উচ্চারণ: “অখণ্ড ভারতের অখণ্ড সত্তার যে পথনির্দেশ, আজ হইতে আরম্ভ হোক তাহারই তপশ্চরণ।” ইতিহাসবিদরা এখন ‘পোস্ট-কলোনিয়াল’ যুগের ‘কলোনিয়াল’ উত্তরাধিকার নিয়ে অনেক গবেষণা করছেন। ইতিহাসের উত্তরাধিকার কী ভাবে দেখা হয়, কী ভাবে তার নবনির্মাণ হয়, কী ভাবে ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে একটা নতুন রাষ্ট্রিক নির্মাণের দিকে এগোতে হয়, তার গুরুত্বপূর্ণ দলিল রয়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতায়।
এইখানে আর একটা কথা জরুরি। ইতিহাসে এই কথা আলোচিত হয়েছে যে, সে দিনের দেশভাগ একটা স্থায়ী ঘটনা হলেও তখনকার মানুষ কিন্তু তাতে ততটা ‘চিরস্থায়ী’, এমনকি ‘দীর্ঘস্থায়ী’ হিসেবেও দেখেনি। আর তাই, বাঙালি সমাজে ‘স্বাধীনতা’র স্পষ্ট ও সম্পূর্ণ উপলব্ধি সম্ভব হয়েছিল সেই পনেরো অগস্ট, কিন্তু ‘দেশভাগ’-এর স্পষ্ট ও সম্পূর্ণ উপলব্ধি একেবারেই হয়নি। আরও বেশ কিছু মাস, এমনকি কিছু বছর, এক রকমের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বাস্তব-অবাস্তব, নিশ্চিতি-অনিশ্চিতির আশ্চর্য দোলাচলে ডুবে যায় বাংলাভাগের অভিজ্ঞতা— পঞ্জাবের চেয়ে যা বেশ অনেকখানি আলাদা বলেই মনে করেন ইতিহাসবিদরা। আনন্দবাজারের পৃষ্ঠায় তাই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সরাসরি উঠে আসে এই দোলাচল: “বাঙলার যে অংশ ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়া পাকিস্তানে পরিণত হইতেছে, তাহার জন্য গভীর বেদনা অনুভব করিতেছি। আমাদের দৃঢ় ও স্থির বিশ্বাস এই বিচ্ছেদ সাময়িক। এই অস্বাভাবিক বিচ্ছেদ দীর্ঘকাল স্থায়ী হইতে পারে না। অচিরকাল মধ্যে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাঙলা আপনার স্বার্থেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিবে।”
এই দোলাচল বাংলায় ছিল, আর পঞ্জাবে ছিল না বলেই কি বাংলার থেকে অনেক বেশি রক্তাক্ত ও হিংস্র হয়ে উঠেছিল পঞ্জাব? দেশভাগের মুহূর্তে পঞ্জাব যখন জ্বলছে, বাংলা কিন্তু তখন শান্ত। বিশেষত কলকাতায় তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আশ্চর্য আবহাওয়া। কলকাতায় কেবল গাঁধীজির উপস্থিতি এর কারণ হতে পারে না। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা অত্যন্ত গুরুতর সামাজিক বার্তা। বাংলার হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সমাজের একটা আলাদা সহজীবিতার ছবি। এই ছবিকে আকস্মিক, আপতিক, কাকতালীয় কিংবা কোনও নেতার অঙ্গুলিচালিত বলে ভাবলে বাংলার মানুষকেই ভুল চেনা হবে। যে কলকাতায় কিছু দিন আগেই ঘটে গিয়েছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রলয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, সেই শহর পনেরো অগস্ট রাত্রিটিতে কেমন ছিল? —অতুলনীয় বর্ণনা থেকে গেল ষোলো তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায়।
“মধ্যরাত্রে ১২ ঘটিকার নির্ঘোষের সঙ্গে সঙ্গে নগরীর পল্লীতে পল্লীতে তুমুলরবে শঙ্খ, ঘণ্টা, বিউগিল ও সাইরেনের ধ্বনি উত্থিত হয়। নারীকণ্ঠে মুহুর্মুহুঃ উলুধ্বনি ঝঙ্কৃত হইয়া ওঠে। দিকে দিকে বিস্ফোরণের শব্দে দিগমণ্ডল প্রকম্পিত হইতে থাকে। শহরের উপকণ্ঠস্থিত ট্রেনসমূহের ইঞ্জিন হইতেও বাঁশী বাজাইয়া ভারতবর্ষের মুক্তির বার্তা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন পল্লীতে শত শত বৈদ্যুতিক গ্রামোফোন যন্ত্রে ‘বন্দে মাতরম’ গীত হইতে থাকে।” (১৬ অগস্ট, ১৯৪৭) কাগজের নানা রিপোর্টে বর্ণিত হয়, কলকাতায় সে দিন কারও কোনও বিরোধ নেই, হানাহানি তো নেই-ই, নেই কোনও মহল্লা ভাগাভাগি। আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায় হেডলাইন, কলকাতার “রাস্তায় রাস্তায় হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত আনন্দোৎসব”— “রাস্তা দিয়া চলিতে কোনও বিপদ ঘটিতে পারে এ কথা কাহারো মনে জাগে নাই। লরিতে করিয়া দলে দলে একে অপরের এলাকায় নির্ভয়ে চলাফেরা করিতেছিল।” মুসলমান অঞ্চলগুলিতে উড়তে দেখা যায় তেরঙা পতাকা। এন্টালির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড হয়ে মহাত্মা গাঁধীর গাড়ি যখন যাচ্ছে পার্ক সার্কাসের দিকে, ড্রাইভারের আসনে বসে আছেন স্বয়ং সুরাবর্দি— অজস্র উৎফুল্ল মানুষের ভিড় ধাওয়া করে, ঘিরে ধরে সেই গাড়ি, এক বার মহাত্মাকে চোখের দেখা দেখতে অস্থির হয়ে ওঠে কলকাতার হিন্দু-মুসলমান মানুষ।