ঢেলে বিকোচ্ছে এমনই হেলমেট। মঙ্গলবার, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
এ যেন নিয়মরক্ষায় নিয়ম মানা!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে— ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’। গত ৮ জুলাই এই নির্দেশিকা জারি হতেই কলকাতা থেকে মফস্সল— সর্বত্রই রাতারাতি বেড়ে গিয়েছে হেলমেট বিক্রি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সত্যিই কি সেই সব হেলমেট তাঁদের মাথার সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে? নাকি স্রেফ নিয়মরক্ষা করতেই মোটরবাইক আরোহীদের মাথায় উঠছে হেলমেট?
শহর থেকে জেলা— সর্বত্রই বেপরোয়া বাইক-আরোহীদের শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, হেলমেট পরা না থাকলে কেউ বাইকে জ্বালানি ভরাতে পারবেন না। আবার পেট্রোল পাম্প যদি বিনা হেলমেটের আরোহীকে জ্বালানি দেয়, তা হলে তাদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফলে হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক চালানোই যাঁদের কাছে দস্তুর হয়ে উঠেছিল, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশি কড়াকড়ি শুরু হতেই হেলমেট কিনছেন তাঁরাও।
কিন্তু সকলেই কি সঠিক গুণগত মানের হেলমেট কিনছেন?
কলকাতার বিভিন্ন দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, গত কয়েক দিনে বিক্রি হওয়া অধিকাংশ হেলমেটেরই দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। যা কার্যত খেলনা হেলমেটের সামিল। বড় কোনও দুর্ঘটনায় দূরে থাক, মাথায় সামান্য চোট লাগলেও ওই হেলমেট কোনও কাজে আসবে না বলে কবুল করছেন বিক্রেতারাই। তাঁদের কথায়, কথায়, ‘‘বিষয়টা অনেকটা নিয়ম মানতে হবে তাই মানছি গোছের হয়ে গিয়েছে। হেলমেট কেন পরা দরকার, তা নিয়ে অধিকাংশই সচেতন নন। তাই কম দামে যেমন-তেমন হেলমেট কিনে মাথায় চাপিয়েই দায়মুক্ত হচ্ছেন
বাইক-আরোহীরা।’’
মঙ্গলবার দুপুরে ওয়েলিংটন, চাঁদনি মার্কেট, লেনিন সরণিতে মোটরবাইকের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকানগুলিতে গিয়ে দেখা গেল, হেলমেট কিনতে ভিড় জমেছে। দোকানের সামনে রাস্তার উপরে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন রং ও সাইজের হেলমেট। দোকানের ভিতরেও রয়েছে আরও কিছু হেলমেটের পসরা। দোকানিদের থেকেই জানা গেল, বাইরে রাখা হেলমেটগুলি অতি সাধারণ মানের। আর ভিতরে যেগুলি রয়েছে, সেগুলি দামি ও টেকসই।
মাথায় তাদের নেইকো...। মঙ্গলবার, ব্যারাকপুরের চিড়িয়ামো়ড়ে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
জানা গেল, ২০০ টাকা থেকে শুরু করে এক-দু’হাজার কিংবা তার চেয়েও বেশি দামের হেলমেট রয়েছে পসরায়। ব্র্যান্ডেড ও শক্তপোক্ত হেলমেটের দাম শুরু মূলত ৭০০ টাকা থেকে। সে ক্ষেত্রে তার চেয়ে কমদামি হেলমেট বিক্রি মানে তো লোক ঠকানো? ওয়েলিংটনের এক দোকানি রাজু জায়সবাল সোজাসাপ্টা বলছেন, ‘‘কম দামের হেলমেট বিক্রি করা মানে সত্যিই ক্রেতাকে ঠকানো। কিন্তু আমরা কী করব? খদ্দের যা চাইছে, তাই দিচ্ছি।’’ দোকানিদের কথায়, ‘‘নিয়ম চালু হয়েছে, খুব ভাল কথা। কিন্তু কোন মানের হেলমেট ব্যবহার করা হচ্ছে, সে দিকেও প্রশাসনকে নজর দিতে হবে।’’
ওয়েলিংটনের ‘ইস্টার্ন অটো’ নামে একটি দোকানের মালিক পবিত্র চৌধুরী জানান, কম দামের হেলমেটগুলি মূলত প্লাস্টিকের তৈরি। তার উপরে বিভিন্ন রং করে স্টিকার লাগানো থাকে। ট্যাগ কিংবা বার-কোডের বালাই নেই। তবে কম দামের হেলমেটেও আইএসআই ছাপ থাকে। যদিও তা সামান্য আঘাতেই ভেঙে যায় কিংবা চিড় ধরে যায়। অন্য দিকে বেশি দামের হেলমেট তৈরি হয় ফাইবার দিয়ে। ভিতরে থার্মোকলের আস্তরণও অনেক পুরু মাত্রায় থাকে। শুধু তা-ই নয়, ‘আইএসআই’ ছাপ হেলমেটের পিছনে ও ভিতরে দু’জায়গাতেই থাকে। এ ছাড়াও হেলমেটের ট্যাগে থাকে বার-কোড। এই হেলমেট অনেক বেশি মাত্রার আঘাত সহ্য করতে পারে। সহজে ভাঙে না।
একটু দামি ও গুণগত মান বজায় রয়েছে, এমন হেলমেট কেন ব্যবহার করা উচিত, সে বিষয়ে লেনিন সরণির ‘শ্রী বালাজি অটো ডিস্ট্রিবিউটর প্রাইভেট লিমিটেড’-এর তরফে আদিত্য গুপ্ত বলেন, ‘‘হেলমেটের বাইরের অংশ আঘাত থেকে রক্ষা করে, আর ভিতরের অংশ ওই আঘাতের জেরে ঝাঁকুনি থেকে মাথা বাঁচায়। গুণগত মান ঠিক না থাকলে তা সম্ভব নয়।’’
যদিও দোকানিরা বলছেন, সাধারণ বাইক-আরোহীদের অনেকেই জানেন না হেলমেটের কতগুলি প্রকারভেদ রয়েছে। কারণ, পুলিশের নিয়মানুযায়ী হেলমেটে আএসআই ছাপ থাকলেই জরিমানা করা হয় না। তাই কম দামের হেলমেট কিনেই নিয়মরক্ষা করেন বহু বাইক-আরোহী। এ প্রসঙ্গে আদিত্যবাবু নিজের অভিজ্ঞতা, ‘‘বছর কয়েক আগে দেখেছি, হায়দরাবাদে হেলমেট না থাকলে বাইক চালকের লাইসেন্স জমা নিয়ে নেওয়া হতো। তার পরে সেই আরোহীকে রোজ পুলিশের আয়োজিত প্রশিক্ষণ শিবিরে ক্লাস করতে যেতে হতো। সেখানে শেখানো হতো— কেন হেলমেট পরবেন, কী হেলমেট পরবেন।’’ এখানেও তেমন কিছু চালু করা গেলে হয়, বলছেন তিনি।
রাজ্য পুলিশের এডিজি (ট্রাফিক) কুন্দনলাল টামটা বলেন, ‘‘মানুষকে আগে হেলমেট পরা অভ্যাস করাতে হবে। সে বিষয়ে সচেতনতাও বাড়ানো হচ্ছে। তবে হেলমেট কেনার সময়ে তার গুণগত মান সম্পর্কেও আরোহীদের সচেতন হওয়া উচিত। আমরাও লক্ষ রাখব, কেউ যাতে নকল বা নিম্ন মানের হেলমেট না পরেন।’’
হেলমেট নেই, ধৃত ১০। ওত পেতেই ছিল পুলিশ। বাইপাস থেকে দ্রুত কামালগাজি উড়ালপুলে উঠতেই একে একে ধরা হল হেলমেটহীন মোটরবাইক আরোহীদের। পুলিশ জানায়, তারা মূলত রেসের জন্য সেখানে জমা হচ্ছিল। সোমবার রাত সাড়ে আটটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ ভাবেই ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আটক হয়েছে ২৫টি মোটরবাইক। পুলিশ জানায়, এ বার থেকে সোনারপুর থানা এলাকার ওই তল্লাটে নিয়মিত অভিযান চলবে।