যে বহুতলে এই বিস্ফোরণ হয়েছে সেই সীমা অ্যাপার্টমেন্টের প্রোমোটার রণবীর বিশ্বাস ওই বাড়িতেই থাকেন। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘সকাল তখন সাড়ে ৯টা হবে। আমি ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই বিশাল একটা আওয়াজ। কেঁপে ওঠে গোটা বাড়িটা। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে কাচের দরজা-জানলা। তড়িঘড়ি নীচে নেমে এসে দেখি মিষ্টির দোকানের শাটারটা উড়ে গিয়েছে। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটি়য়ে বেশ কয়েক জন। ওদের সকলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গে।’’
ঘটনার পর নাগেরবাজারে পৌঁছয় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের বিশাল বাহিনী। প্রাথমিক তদন্তের পর কমিশনার রাজেশ কুমার বলেন, ‘‘দেশীয় পদ্ধতিতে বানানো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সকেট বোমাই ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সেই জন্যই বিস্ফোরণের এত প্রবল অভিঘাত। প্রাথমিক ভাবে আমরা এখনও কোনও ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি)-এর হদিশ পাইনি।’’
ঘটনার পরই এলাকায় একটি মুখ বাঁধা বস্তা পাওয়া যায়। সিআইডির বম্ব ডিটেকশন এ্যান্ড ডিসপোসাল স্কোয়াডের বিশেষজ্ঞরা বিশেষ পোশাক পরে ওই বস্তা খুলে দেখেন। কিন্তু সেই বস্তা থেকে কিছু ধূপকাঠির প্যাকেট এবং খাতা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
দেখুন ভিডিয়ো
আরও পড়ুন: মমতার সঙ্গে রাজনাথের একান্ত আলাপচারিতা, অস্বস্তি চাপছে বিজেপি
নাগেরবাজার মোড় থেকে ২০০ মিটার দূরে কাজিপাড়ায় সীমা অ্যাপার্টমেন্ট। পাঁচ তলা ওই বহুতলের ঠিকানা ৯ নম্বর যশোহর রোড। সেই বহুতলের নীচে ‘বাসন্তী সুইটস’ নামে একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। দোকানের পাশেই তার মালপত্র রাখার গুদাম। ঘটনার সময় সেটির শাটার বন্ধ ছিল। তার ঠিক পাশেই একটি বন্ধ দোকানের সামনে অজিত হালদারের ফলের দোকান। এ দিন সকালে তিনি সেখানে বসেই ফল বিক্রি করছিলেন। হঠাৎ করেই প্রবল বিস্ফোরণ। ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছেন অজিতবাবু। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ওই মিষ্টির দোকানে কাজ করেন জয় ঘোষ। তাঁর স্ত্রী সীতা ওই পাড়াতেই একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। তাঁদের আট বছরের ছেলে বিভাস কেকে হিন্দু অ্যাকাডেমিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। এ দিন স্কুলে গাঁধী জয়ন্তীর ছুটি ছিল বলে মায়ের সঙ্গে সে কাজের বাড়িতে যাচ্ছিল। কারণ, ছুটির দিন মায়ের সঙ্গে ওই বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখত বিভাস। মাঝপথে ওই বিস্ফোরণে গুরুতর জখম হন সীতা ও বিভাস। পরে হাসপাতালে বিভাসের মৃত্যু হয়। ‘বাসন্তী সুইটস’-এর অন্য একটি আউটলেট রয়েছে মতিঝিলে। জয়ের ডিউটি এ দিন সেখানেই ছিল।স্ত্রী-পুত্র যখন গুরুতর জখম হয়ে রাস্তায় পড়ে, জয় তখন সেখানে ডিউটি করছিলেন। ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে আসেন হাসপাতালে। ছেলের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
স্থানীয় বিধায়ক সুজিত বসু এ দিন সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে জানিয়েছিলেন, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে ওই ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু, পরে পুলিশ জানায় কোনও গ্যাস সিলিন্ডার ফাটেনি। উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন শকেট বোমা ফেটেই এই ঘটনা ঘটেছে। গ্যাস সিলিন্ডারের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন বাসন্তী সুইটস-এর কর্মী মিঠুন গড়াই। তাঁর কথায়: ‘‘এখানে কোথাও কোনও গ্যাস সিলিন্ডার ছিল না। বিস্ফোরণের পর দেখেছি, প্রায় ১০০ মিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর জালকাঠি।’’ একই দাবি করেছেন ওই দোকানেরই আর এক কর্মী রাজেন্দ্র ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তায় অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্প্লিন্টার এবং শ্র্যাপ নেল। গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ হলে ও সব এল কোথা থেকে?’’
দেখুন ভিডিয়ো
কিন্তু, এই বিস্ফোরণ ঘটাল কারা? এত শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানোই বা কেন হল?
গোটা বিষয় নিয়ে এখনও অন্ধকারে পুলিশ। তবে যে এলাকায় বিস্ফোরণ হয়েছে, দক্ষিণ দমদমের সেই ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পাচু রায় ওই পুরসভার পুরপ্রধানও। যে বহুতলে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেখানে তাঁর একটি অফিসও রয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন সেখানে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেখা করেন। এ দিন ঘটনার পর তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল কর্মীদের টার্গেট করতেই এই বিস্ফোরণ। হয়তো আমিও টার্গেট ছিলাম।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে রাজ্যের মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘আরএসএস-বিজেপি এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা যথেষ্ট পাকা হাতের কাজ। সিপিএমের এত ক্ষমতা নেই। যারা বাংলা দখলের চেষ্টা করছে, এ ঘটনা তারাই ঘটিয়েছে।’’
এ দিন দুপুরে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঘটনাস্থলে পৌঁছন। তিনি বলেন, ‘‘আমার জীবদ্দশায় এমন ঘটনার কথা শুনিনি দমদমে। বিজেপি দিনেদুপুরে মানুষ মেরে দেওয়ার রাজনীতি করছে। ওরা পাচু রায়কে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। একটি বাচ্চার প্রাণ গেল। আরও এক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এমন ঘটনা মেনে নেওয়া হবে না।’’
যদিও এই অভিযোগ প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘তৃণমূলের একটা বাতিক হয়ে গিয়েছে, যেখানে যা হবে বিজেপি-র ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, যেখানে তৃণমূলের পার্টি অফিস সেখানেই বোমা ফাটছে। আর ওরা বলছে, বিজেপি-র হাত আছে। ঝাড়খণ্ড থেকে লোক আসছে। ধরতে পারছে না কেন? পুলিশ কী করছে? তৃণমূলের পার্টি অফিসগুলো সমাজবিরোধীদের আখড়া হয়ে গিয়েছে। কলকাতাও সুরক্ষিত নয়। এই সরকারের আর থাকার অধিকার নেই।’’
(কলকাতা শহরের রোজকার ঘটনার বাছাই করা বাংলা খবর পড়তে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।)