চলতি বছরের মধ্যে শহরের মহিলা প্রধান বাড়ি-সহ (ফিমেল হেডেড হাউসহোল্ড বা এফএইচএইচ) কমপক্ষে ৯০ হাজার আবাসিক বাড়িতে জলের মিটার বসানোর কথা। যাতে জল অপচয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ হিসেব পাওয়া যায় এবং ধাপে ধাপে পরিস্রুত পানীয় জলের মাসুল (ওয়াটার ট্যারিফ) আদায়ের পথে হাঁটা যায়। কারণ, পানীয় জল সরবরাহ ও নিকাশির পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য কলকাতা পুরসভাকে ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে জলের মাসুল আদায়ের কথা বহু বছর ধরেই বলে এসেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক বা এডিবি)।
অথচ পুরসভার তথ্য বলছে, ১-৬ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমানে যেখানে ‘পাইলট প্রজেক্ট’-এর কাজ হচ্ছে, সেখানে এখনও পর্যন্ত প্রায় ন’হাজার বাড়িতে জলের মিটার বসেছে। প্রথমে ২৫ হাজার বাড়িতে মিটার বসানোর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলেও সরেজমিন সমীক্ষায় প্রায় ১৮ হাজার বাড়ির সংযোগের লাইন পাওয়া যায়। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা এখনও পূরণ
করা যায়নি।
কেন প্রকল্পের গতি এত শ্লথ?
পুর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, কোভিড, আমপান-সহ একাধিক বিপর্যয়ের কারণেই প্রকল্প রূপায়ণে দেরি হচ্ছে। তবুও পূর্ব কলকাতার একাধিক ওয়ার্ডে জলের মিটার বসানোর কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। ফলে দেরি হলেও কাজ এগোচ্ছে। যদিও সেই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন পরিবেশবিদেরা। তাঁদের বক্তব্য, এগুলো অজুহাত মাত্র। আসলে মিটার বসানোর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলেই এডিবি-র ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে অবধারিত ভাবে জলের মাসুলের প্রসঙ্গ আসবে। যা নিয়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসক দলের আবার চূড়ান্ত অনীহা রয়েছে। এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘জল-মাসুলের প্রসঙ্গ এড়াতেই মিটার বসানোর কাজের গতি শ্লথ। কারণ, প্রকল্পের কাজ চলছে বলে বছরের পর বছর প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। যাতে জলের উপরে মাসুল বসিয়ে ভোট-জনতার বিরূপ মনোভাবের কারণ না হতে হয়!’’
আর এক পরিবেশ বিজ্ঞানী বলছেন, ‘‘প্রকল্প রূপায়ণে দেরি হলেও তো এডিবি কোনও জরিমানা ধার্য করে না। খুব বেশি হলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তারা সেই সুযোগটা নেয়।’’ পরিবেশ বিজ্ঞানী তপন সাহার আবার বক্তব্য, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, দৈনিক মাথাপিছু ১৩০ লিটার জল প্রয়োজন। সেখানে কলকাতা দৈনিক মাথাপিছু গড়ে ২০২ লিটার জল পায়। তার পরেও শহরে জলের অপচয় চলছে। ফলস্বরূপ, এক দলের জলের অপচয়ের কারণে আর এক দল পর্যাপ্ত জল পাচ্ছে না!’’
অথচ রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার’ সংক্রান্ত কমিটি ২০০২ সালের নভেম্বরে ‘জলের অধিকার’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছিল,—‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ, গ্রহণযোগ্য, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যের জলের অধিকার প্রতিটি মানুষের রয়েছে।’ আবার ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘মানবাধিকার কাউন্সিল’ নিজেদের গ্রহণ করা ১৬/২ ‘রেজ়োলিউশন’-এ বলেছিল,—‘পরিস্রুত পানীয় জলের অধিকারহল জীবনের অধিকার ও মানুষের মর্যাদার অধিকার।’
কিন্তু বছরের পর বছর সমস্ত রাজনৈতিক দল স্বার্থ পূরণের জন্য সেই ‘মর্যাদার অধিকার’কে উপেক্ষা করে এসেছে। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তবে কি এমন একটি দিন অপেক্ষা করছে, যখন জলশূন্য হয়ে যাবে এ শহর? প্রবহমান গঙ্গার উপস্থিতি সত্ত্বেও?
নদী-বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকারের কথায়, ‘‘বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ঠিক পদ্ধতি না মানার জন্য গঙ্গার বাস্তুতান্ত্রিক প্রবাহ (ইকোলজিক্যাল ফ্লো) ইতিমধ্যেই ব্যাহত। যে কারণে শুধু কলকাতা কেন, সারা দেশেই গঙ্গার অস্তিত্ব বিপন্নের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর গঙ্গার অস্তিত্ব বিপন্ন হলে কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়।’’ কলকাতা পুর প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম যার পরিপ্রেক্ষিতে বলছেন, ‘‘জল অপচয় না করার জন্য মানুষের সচেতনতার উপরেই আমরা আপাতত জোর দিচ্ছি। ইচ্ছাকৃত ভাবে রাস্তার কলের মুখ ভেঙে ফেলা হলে কড়া পদক্ষেপ হিসেবে সেখান থেকে কলও তুলে দিচ্ছি। কারণ, জল অপচয় করা
চলবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy