Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Mamata Banerjee

Mamata Banerjee: দলের সংগঠন তিনি দেখবেন, সাংসদদের বৈঠকে সাফ বার্তা দিলেন নেত্রী মমতা

বাজেট অধিবেশনের সময় তৃণমূলের সাংগঠনিক ভোট। তাতে যোগ দিতে বাকি সাংসদরা কলকাতা ফিরলেও মমতার নির্দেশ, দিল্লিতেই থাকবেন সৌগত, সুদীপ ও জহর সরকার।

তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:০৪
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গে সরকারের পাশাপাশি তৃণমূলের দলীয় সংগঠনের রাশও নিজের হাতে তুলে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার দলীয় সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে দলনেত্রী মমতা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এখন থেকে বাংলার সংগঠন তিনিই দেখবেন। প্রসঙ্গত, আগামী ২ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাংগঠনিক নির্বাচন। সেখানে মমতা দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হবেন। তার আগে এই বার্তা আরও ‘ইঙ্গিতবহ’ বলে দলের নেতাদের বক্তব্য।

বৈঠকে মমতা সাফ জানান, তৃণমূল কংগ্রেস অনেক আন্দোলনের ফসল। অনেক যুদ্ধের পর দল এই বটবৃক্ষের জায়গায় পৌঁছেছে। পাশাপাশি তিনি বলেন, পশ্চিমবাংলাই তাঁদের সবকিছু। বাংলাই তৃণমূলকে সবকিছু দিয়েছে। বাংলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দলীয় সূত্রের খবর, বৈঠকে আরামবাগের সাংসদ অপরূপা পোদ্দারকে খানিক বকুনিও দিয়েছেন মমতা। জানিয়েছেন, তিনি একাধিক বার অপরূপাকে ফোন করেছিলেন। সবসময়েই তাঁর ফোনে ‘রেকর্ডেড মেসেজ’ শোনা গিয়েছে। অপরূপা পরে আর ফোনও করেননি। জবাবে অপরূপা বলেন, তাঁর করোনা হয়েছিল। তাই তিনি ফোন ধরতে পারেননি। নেত্রীকে ফোন না করার কোনও উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।

কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সাংবাদিক বৈঠক করে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়ার জন্য মমতার কাছে অপরূপা সতর্কিত হয়েছেন বলেও তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি। তাঁর ওই কাজের জন্য অপরূপা ক্ষমা চেয়েছেন বলেও দলীয় সূত্রে দাবি করা হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এর কোনও সমর্থন মেলেনি।

পাশাপাশিই দলনেত্রী মমতা সাংসদদের বৈঠকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন, দলীয় দফতরে বা প্রকাশ্যে বসে দল সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করা চলবে না। যদি কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকে, তা দলের অন্দরেই জানাতে হবে। সাংসদদের কোনও সমস্যা থাকলে তা জানাতে হবে লোকসভায় দলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাজ্যে বিধায়ক বা অন্য নেতাদের কোনও সমস্যা থাকলে তা জানাতে হবে সুব্রত বক্সিকে।

দলনেত্রীর ওই বক্তব্যের একাধিক ব্যাখ্যা তৃণমূলের অন্দরে শুরু হয়েছে। এক অংশের মতে, এ বার থেকে বাংলায় সংগঠন তিনি নিজে দেখবেন জানিয়ে মমতা দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন। ওই অংশের দাবি, যে বার্তাৎ মমতা প্রকারন্তরে বলতে চেয়েছেন— গোয়া, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তাঁর চিন্তা বাংলা নিয়ে। সেখানে তিনিই শেষ কথা বলবেন। অর্থাৎ বাংলার বাইরের রাজ্যগুলিতে সংগঠন বৃদ্ধি নিয়ে অভিষেক পরিকল্পনা করতে পারেন।

আবার অন্য পক্ষের বক্তব্য, প্রকাশ্যে বা দলের দফতরে বসে দলের বিষয়ে বিবৃতি দেওয়া চলবে না বা কোনও ‘আলগা’ মন্তব্য করা চলবে না বলে মমতা বার্তা দিতে চেয়েছেন ‘বিক্ষুব্ধ’ সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যিনি অভিষেককে নিয়ে প্রকাশ্যে বিভিন্ন মন্তব্য করে দলের ‘বিড়ম্বনা’ বাড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধ বেধেছিল তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ তথা অধুনা দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষেরও। তবে এখন সেই বিতর্ক থেমে গিয়েছে। মমতা এবং দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপের পর এখনও পর্যন্ত কল্যাণ নীরব আছেন।

তবে এই দু’টি ব্যাখ্যারই কোনও আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি। বৈঠকে উপস্থিত সাংসদদের কেউই এই নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চাননি। ফলে এই ব্যাখ্যার সত্যাসত্য নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বৃহস্পতিবারের ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রায় সব সাংসদই উপস্থিত ছিলেন। মমতার সঙ্গে ছিলেন অভিষেক, সুদীপ এবং সুব্রত বক্সি। অভিষেক গোয়া থেকে ফিরে বিমানবন্দর থেকেই সরাসরি এসে বৈঠকে যোগ দেন। বাকিরা যোগ দেন ভার্চুয়ালি।

অতি সম্প্রতি দলের অন্দরে ‘যুযু‌ধান’ দুই শিবির নেত্রীর বৃহস্পতি-বক্তব্যের ব্যাখ্যা যার যার নিজের মতো করে করছে। কিন্তু আপাত-নিরপেক্ষ একাধিক সাংসদের অভিমত, মমতা ‘আগ্রাসী’ ভঙ্গিতে কাউকেই কিছু বলেননি। দক্ষ নাবিকের মতো তিনি দলকে যেমন এতদিন চালনা করে এসেছেন, সে ভাবেই সকলকে বার্তা দিয়েছেন। যে বার্তার নির্যাস— বাংলাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দলীয় শৃঙ্খলা মানতে হবে। কাউকেই তার অন্যথা করলে চলবে না।

বাংলার বিভিন্ন জেলায় আসন্ন পুরভোট নিয়েও বৈঠকে নির্দেশ দেন মমতা। জানান, সাংসদদের প্রার্থী বা ওই সংক্রান্ত কোনও মতামত বা বক্তব্য থাকলে তাঁরা যেন পার্থ এবং সুব্রত বক্সির সঙ্গে কথা বলেন। মমতা নিজে তার পর ওই দুই নেতার সঙ্গে কথা বলে নেবেন।

প্রসঙ্গত, কার্যত ‘আপৎকালীন’ পরিস্থিতিতে মমতা সাংসদদের ওই জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন। যার প্রেক্ষিত কল্যাণের ‘বিক্ষুব্ধ’ মন্তব্য।

করোনা-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সর্বভারতীয় তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেকের ‘ব্যক্তিগত মতামত’ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ। একমাত্র মমতাকেই তাঁর ‘নেতা’ হিসেবে দাবি করে কল্যাণ বলেছিলেন, অন্য কাউকে তিনি নেতা মানেন না। সঙ্গে জুড়েছিলেন, ‘‘গোয়া, ত্রিপুরায় অভিষেক সাফল্য পেয়ে দেখান! তার পর তাঁকে নেতা বলে মেনে নেব!’’

এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে তুমুল জলঘোলা চলে। তৃণমূলের অন্দরে অভিষেকের পক্ষ নিয়ে একের পর এক সাংসদ-নেতা কল্যাণকে আক্রমণ করতে থাকেন। পরিস্থিতি সামলাতে মমতার নির্দেশে আসরে নামেন দলের মহাসচিব তথা তৃণমূলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির প্রধান পার্থ। তিনি বিবদমান সকলের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর হস্তক্ষেপে বিরতি পড়ে বিতণ্ডায়।

ঘটনাচক্রে, গোয়া সফরে ওই বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন অভিষেকও। কিন্তু তিনি ‘কৌশলী’ জবাবে বলেন, ‘‘কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো ঠিকই বলেছেন। দলে আমারও নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কাউকে নেতা মানি না।’’ কল্যাণও তার পাল্টা অভিষেককে ‘মাননীয় সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক’ বলে উল্লেখ করেন। এর পরেই ক্রমশ থিতিয়ে যায় বিতর্ক।

তার পরেই মমতা সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকটি ডাকেন। যেখানে তিনি উভয় তরফকেই ‘বার্তা’ দিয়েছেন বলে দলের অধিকাংশ নেতা মনে করছেন। মমতা একদিকে যেমন বলেছেন, ‘‘দলের দফতরে বসে বা প্রকাশ্যে দল বা দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করবেন না। যা বলার দলীয় মঞ্চে বলুন।’’ কারণ, সাম্প্রতিক বিতর্কের সময় কয়েকজন সাংসদ সম্পর্কে অনুযোগ উঠেছিল, তাঁরা বিভিন্ন সময় দিল্লিতে দলীয় কার্যালয়ে, সংসদে তৃণমূলের কার্যালয় এবং সেন্ট্রাল হল-এ বসে ‘আলটপকা মন্তব্য’ করেন। মমতা সেই বিষয়েই বার্তা দিলেন বলে একাধিক সাংসদ মনে করছেন। পাশাপাশিই, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলাই দলের অগ্রাধিকার। বাংলার বিষয় তিনিই বুঝে নেবেন। বাকি দেশ অন্যরা (পড়ুন অভিষেক) দেখুন। প্রসঙ্গত, অভিষেক-প্রণীত ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতিতে কলকাতা পুরভোটের আগে মেয়র ফিরহাদ (ববি) হাকিম-সহ বিধায়কদের মনোনয়ন বাতিলের বিষয়েও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মমতা। তাঁর হস্তক্ষেপেই ববি-সহ পাঁচ বিধায়ক কাউন্সিলারের টিকিট পান। জেতেন। ফিরহাদ আবার কলকাতার মেয়র হন।

এ দিন বৈঠকে আসন্ন বাজেট অধিবেশনে তৃণমূলের রণকৌশল নিয়েও দিশানির্দেশ দেন মমতা। বৈঠকে দলনেত্রী সাংসদদের নির্দেশ দেন, পাঁচ রাজ্যের ভোটের সময় বাজেট অধিবেশন কেন হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। নতুন ক্যাডার নীতি নিয়েও সাংসদদের সরব হতে বলেন তিনি। পাশাপাশি নেতাজির ট্যাবলো বাতিল করে বাংলার সঙ্গে কেন্দ্র কেন নোংরা রাজনীতি করল, তাও উত্থাপনের বিষয়ে সাংসদদের নির্দেশ দেন মমতা।

প্রসঙ্গত, সংসদের বাজেট অধিবেশন চলাকালীনই তৃণমূলের সাংগঠনিক ভোট। সেখানে অংশ নিতে বাকি সাংসদরা কলকাতা ফিরলেও মমতার নির্দেশ, দিল্লিতেই থেকে যাবেন সৌগত রায়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জহর সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE