Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বিশেষ শিশুদের আধার রয়েছে আঁধারেই

পরিস্থিতি ফের জটিল হল আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময়ে। কিছুতেই যন্ত্রের উপরে আঙুল রাখবে না শিশুটি। শুরু হল চিৎকার, সঙ্গে কান্না। কোনওক্রমে সবাই জোর করে চেপে ধরে তাকে ছাপ দেওয়ালেন। লাভ হল না।

মেয়ে বীণাশ্রীকে নিয়ে জয়শ্রী কুণ্ডু। মেয়ের আধার কার্ড করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন তিনিও। নিজস্ব চিত্র

মেয়ে বীণাশ্রীকে নিয়ে জয়শ্রী কুণ্ডু। মেয়ের আধার কার্ড করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন তিনিও। নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৮ ০২:৫৪
Share: Save:

আধার কার্ড করানোর প্রবল ভিড়। তার মধ্যেই মাঝে মাঝে চিৎকার করে উঠছে বছর ছয়েকের ছেলেটি। কোনও মতে তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন মা। কয়েক মিনিট পরে শিশুটিকে এনে বসানো হল ক্যামেরার সামনে। চোখের ছবি তোলা হবে তার। কিন্তু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা তো দূর, বারবার মুখটাই ফিরিয়ে নিচ্ছে সে। ঘাড় ধরে মাথা সামনের দিকে ঘুরিয়ে বহু কষ্টে ছবি তোলা হল অটিজমের শিকার ওই শিশুটির।

এরই মধ্যে উড়ে এল নানা বিরূপ মন্তব্য। এক আধারকর্মীর ক্ষোভ, ‘‘কেন যে এদের এখানে আনে! আধার হবে না, চলে যান।’’

পরিস্থিতি ফের জটিল হল আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময়ে। কিছুতেই যন্ত্রের উপরে আঙুল রাখবে না শিশুটি। শুরু হল চিৎকার, সঙ্গে কান্না। কোনওক্রমে সবাই জোর করে চেপে ধরে তাকে ছাপ দেওয়ালেন। লাভ হল না। ছাপ ঠিকঠাক আসেনি বলে ফের জোর করা হল তাকে। সপ্তম বারের চেষ্টায় ছাপ নিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন আধার ক্যাম্পের কর্মীরা।

তত ক্ষণে শিশুটির করুণ অবস্থা। ভিডিও গেম খেলতে দিয়ে তাকে শান্ত করলেন মা। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে কেন আমাদের বাচ্চাদের সকলের সঙ্গে আধার কার্ড করাতে হবে? ওদের জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেই কেন?’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘বারবার অনুরোধ করেছিলাম, বায়োমেট্রিক করাতে বাড়িতে যেতে। কেউ যাননি। তাই বাধ্য হয়ে এসেছি।’’

শুধু ওই শিশুটি নয়, আধার কার্ড করানোর ক্ষেত্রে এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত বিশেষ শিশুদের অনেককেই। অটিস্টিক শিশুদের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার অভিযোগ, ওই স্কুলের যে সব শিশু আধারের জন্য বায়োমেট্রিক করাতে গিয়েছে, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে আধার-ভীতি চেপে বসেছে তাদের মনে।

এক অটিস্টিক শিশুর মা জয়শ্রী কুণ্ডু জানান, অটিস্টিক বাচ্চাদের অচেনা পরিবেশে সমস্যা হয়। বেশি আওয়াজ, আলোয় বিরক্ত হয়ে যায় তারা। অচেনা ব্যক্তির চোখের দিকে তাকাতে, এক সঙ্গে একাধিক নির্দেশ মেনে কাজ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয় তাদের।

হাওড়ার বাসিন্দা মৌ সেনগুপ্ত আবার বলেন, ‘‘আধার কার্ড করানোর জন্য ছেলেকে আগাম একটা ধারণা দিয়েছিলাম। তাতে ওদের একটু সুবিধা হয়। কিন্তু কার্ড করাতে গিয়ে অন্তত চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ছেলে অতিষ্ঠ হয়ে কান্না জুড়ে দেয়। কোনও মতে কার্ড করাতে পারি।’’

একই ধরনের অভিযোগ নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন বেহালার বাসিন্দা, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত সনৎ মৈত্রের পরিবার। তাঁর মা কোর্টে জানিয়েছিলেন, নানা ক্যাম্পে ঘুরেও ছেলের আধার কার্ড করাতে পারেননি। উল্টে জুটেছিল দুর্ব্যবহার। পরে ওই মাসেই সনতের বাড়ি গিয়ে আধার কার্ড করানোর নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। সেই মতো বাড়ি গিয়ে সনতের আধার কার্ডের জন্য বায়োমেট্রিক নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা হয়। তা সত্ত্বেও কার্ড পেতে বেশ কিছু দিন ঘুরতে হয়েছিল তাঁদের। পরে সাইবার ক্যাফে থেকে তাঁরা কার্ডের প্রতিলিপি বার করেন বলে দাবি সনতের মা নূপুর মৈত্রের।
তাঁর ছেলের ঘটনার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলেই দাবি নূপুরদেবীর। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কোর্টে যেতে পেরেছিলাম। তাই আধার কার্ড হয়েছে। যাঁরা পারছেন না, তাঁদের এখনও একই রকম অবস্থা।’’

এ নিয়ে এই মুহূর্তে কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই বলেই প্রশাসন সূত্রের খবর। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বাড়িতে গিয়েই আধার কার্ড করানোর কথা। সে কাজ যে হচ্ছে না, তা প্রশাসনও জানে।

তবে বিষয়টি আধার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউআইডিএআই-এর (ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া) এক্তিয়ারভুক্ত হওয়ায় তাদেরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে জানাচ্ছেন আধিকারিকদের একাংশ।

ইউআইডিএআই-এর এক আধিকারিক বলেন, ‘‘আমাদের ওয়েবসাইটে আবেদন করলে দ্রুত ওই শিশুদের আধার করে দেওয়া হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Aadhaar Differently-Abled
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE