Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

চৌখুপি ময়দানে হার না মানার লড়াই ছোট্ট স্নেহার

লড়াইটা যত না অভাবের সঙ্গে, তার চেয়েও বেশি মুখ ফিরিয়ে রাখা সমাজের সঙ্গে। টালা থেকে টালিগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা কয়েক জন শুভানুধ্যায়ী বারবার বাড়াচ্ছেন হাত। ১ নভেম্বর গুরুগ্রামে খেলতে যাচ্ছে স্নেহা।

দাবার সামনে স্নেহা। —নিজস্ব চিত্র

দাবার সামনে স্নেহা। —নিজস্ব চিত্র

সুনন্দ ঘোষ ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ০৫:৪১
Share: Save:

ফাইট স্নেহা, ফাইট।

লড়াইটা যত না প্রতিপক্ষের সঙ্গে, তার চেয়ে বেশি অভাবের সঙ্গে।

ফাইট স্নেহা, ফাইট।

লড়াইটা যত না অভাবের সঙ্গে, তার চেয়েও বেশি মুখ ফিরিয়ে রাখা সমাজের সঙ্গে। টালা থেকে টালিগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা কয়েক জন শুভানুধ্যায়ী বারবার বাড়াচ্ছেন হাত। ১ নভেম্বর গুরুগ্রামে খেলতে যাচ্ছে স্নেহা।

আট বছরের স্নেহার কাছে ছক কাটা দাবার বোর্ডই খেলার মাঠ। একরত্তির ওই মেয়ের মগজাস্ত্রের ধারে কুপোকাত একের পর এক প্রতিপক্ষ। স্নেহাকে নিয়ে দিব্যেন্দু বড়ুয়ার বক্তব্য, ‘‘অসম্ভব প্রতিভাশালী মেয়ে। লেগে থাকার ক্ষমতাও প্রশংসনীয়।’’

মহেশতলার একচিলতে ভাড়া ঘরে বাবা-মার সঙ্গে থাকে স্নেহা। বাবা ভগীরথ হালদার ইংরেজি পড়িয়ে সংসার চালান। মা অর্চনা সেলাই করে সাহায্য করেন সংসারে। এমন এক দরিদ্র পরিবারের মেয়েকে যদি প্রতি বছর বিদেশ গিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হয়, তা হলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। কোনওটায় যাচ্ছে, কোনওটায় যেতে পারছে না। এক দিকে মানপত্র, মেডেল জমছে বাড়িতে। অন্য দিকে, আশঙ্কার মেঘ জমছে আগামীর আকাশে।

এই অক্টোবরে ন’বছরের অনূর্ধ্ব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে নেপাল গিয়েছিল স্নেহা। সেখানে প্রথম হয়েছে সে। কিন্তু যাওয়ার বড় বাধা ছিল টাকা। সব শুনে এগিয়ে আসেন স্নেহার কাকার পরিচিত, সোনারপুরের রাজ্য সরকারি অফিসার অমিতাভ ভট্টাচার্য। বাইপাসের কাছে থাকেন স্নেহাদের পারিবারিক বন্ধু স্কুল শিক্ষিকা দেবযানী রায়চৌধুরী। মা এবং বন্ধুর থেকে বেশ কিছু টাকা তুলে দেন তিনিও। সেই ১৫ হাজার টাকা সম্বল করে মেয়েকে নিয়ে যান ভগীরথবাবু।

অগস্টে ব্রাজিলে খেলতে গিয়েছিল স্নেহা। সে বার ভারতের প্রতিনিধিত্ব করায় তার খরচ বহন করেছিল কেন্দ্র। ভগীরথবাবু মেয়েকে বিদায় জানাতে দিল্লি পর্যন্ত যান। বিমানে যাতায়াত করতে অর্চনার গয়না বেচতে হয়েছে।

গুরুগ্রামে জাতীয় প্রতিযোগিতায় যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল ২৫,০০০ টাকা। মিলেছে সেই টাকা। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে ২৫ অক্টোবর স্নেহা আসে রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের কাছে। কমিশন দিয়েছে ১০ হাজার টাকা। কমিশনের দুই সদস্য গায়ক সৌমিত্র রায় এবং চিত্র পরিচালক সুদেষ্ণা রায় ব্যক্তিগত ভাবে যথাক্রমে ১০ হাজার ও ৫ হাজার টাকার চেক দেন।

শিশু কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘স্নেহার মতো প্রতিভাবান শিশু বাংলার গর্ব। টাকার অভাবে যাতে ওকে থমকে যেতে না হয়, আপ্রাণ সেই চেষ্টা করব।’’ দিব্যেন্দু বড়ুয়া নিখরচায় তাকে দাবা শেখান। তাঁর কথায়, ‘‘জনপ্রিয় খেলা না হলে এমন অনেক প্রতিভাই টাকার অভাবে হারিয়ে যায়। এদের সাহায্য করতে সরকারের তহবিল থাকা উচিত।’’

ভগীরথ জানান, এ বছর মার্চে উজবেকিস্তানে জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যাওয়ার জন্য আড়াই লক্ষ টাকার দরকার ছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে টাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বলা হয় তা পেতে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের শংসাপত্র চাই। কিন্তু শংসাপত্র না পাওয়ায় টাকা আসেনি। উজবেকিস্তানেও যাওয়া হয়নি, বলেন ভগীরথ।

শুভানুধ্যায়ীরা ভরসা। তাই লড়াই ফুরোচ্ছে না স্নেহার। দাবার চৌখুপিতে রাজত্ব করার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে লম্বা রেসের ঘোড়া!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE