Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Government Hospital

‘স্বেচ্ছায় নিয়ে যাচ্ছি’ লিখিয়ে নতুন রেফার-ছক হাসপাতালের

অন্য সব সরকারি হাসপাতালের মতো রোগী-হয়রানির এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে আর জি করের বিরুদ্ধেও।

ভোগান্তি: তিন হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি দীনু সাঁতরা। আর জি করে তাঁকে নিয়ে অপেক্ষা পরিজনদের।

ভোগান্তি: তিন হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি দীনু সাঁতরা। আর জি করে তাঁকে নিয়ে অপেক্ষা পরিজনদের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৩৪
Share: Save:

থেঁতলে গিয়েছে বাঁ পা। অবস্থা এমনই যে, পায়ের হাড় পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে। বারাসত হাসপাতাল থেকে ‘রেফার’ হয়ে আসা সেই রোগীকে রক্তাক্ত অবস্থায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ফেলে রেখেছিল বলে অভিযোগ। এর পরে রোগীর স্ত্রীকে দিয়ে একটি কাগজে সই করিয়ে অন্য সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয়। অভিযোগ, সেখানে পৌঁছে পরিজনেরা জানতে পারেন, রোগীকে তাঁরা স্বেচ্ছায় ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বলে বন্ডে সই করিয়ে নিয়েছে হাসপাতাল!

মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা দীনু সাঁতরা নামে ওই রোগীর স্ত্রী মমতা বললেন, “আর জি কর থেকে এন আর এসে যেতে বলা হয়েছিল। সেখানকার ডাক্তারবাবুরা তো কাগজ দেখে আমাকে পুলিশে দেওয়ার কথা বলতে শুরু করলেন। লেখাপড়া জানি না। চিকিৎসকেরা যেখানে সই করতে বলেছেন, সেখানেই করেছি।”

অন্য সব সরকারি হাসপাতালের মতো রোগী-হয়রানির এমন ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে আর জি করের বিরুদ্ধেও। এক বেলা ওই হাসপাতালে থেকে দেখা গেল, জরুরি ভিত্তিতে যাঁদের চিকিৎসা দরকার, এমন রোগীও শয্যা পাচ্ছেন না। বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের অন্য হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে শয্যা ফাঁকা রয়েছে কি না, তা না জেনেই। একই অবস্থা বহির্বিভাগেও। মাসের পর মাস ভর্তির জন্য ঘুরতে থাকা অনেক রোগীই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে শুনছেন, চিকিৎসক আসেননি। অন্য দিন আসতে হবে। দিনভর লাইন দিয়ে বিকেল সাড়ে তিনটেতেও ট্রলি না পাওয়া বছর বাষট্টির এক প্রৌঢ় বললেন, “মায়ের নব্বইয়ের কাছাকাছি বয়স। বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা ট্রলি দরকার। কিন্তু সকাল থেকে লাইন দিয়েও ট্রলি পাইনি। এ বার মাকে কাঁধে নিয়েই আমাকে ছুটতে হবে।”

সেখানেই নিজেদের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন মধ্যমগ্রামের টোটোচালক, বছর বিয়াল্লিশের দীনু সাঁতরার বাড়ির লোকেরা। গত শনিবার কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ উল্টে যায় দীনুর টোটো। তাঁর বাঁ পা থেঁতলে যায়। দ্রুত তাঁকে বারাসত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে ‘রেফার’ করা হয় আর জি করে। দীনুর স্ত্রী মমতা বলেন, “সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এখানে পৌঁছনোর পর থেকে এই বিল্ডিং, ওই বিল্ডিং ঘোরানো হয়। রাত দশটা নাগাদ আমাদের বলা হয়, ওঁর পায়ে যে প্লেট লাগবে তার জোগান এখানে নেই। এন আর এসে যেতে হবে। এর পরেই আমাকে একটি কাগজে সই করিয়ে বলা হয়, এটা সঙ্গে রাখুন। দেখতে চাইলে দেখাবেন।”

মমতার অভিযোগ, এর পরে এন আর এসে গেলে সেখানেও রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ঘোরানো হয় তাঁদের। তার পরে বলা হয়, “এই রোগীকে আপনারা নিজেরাই ছাড়িয়ে এনেছেন? রোগীর বাড়ির লোককে পুলিশে দেওয়া হবে।” মমতা বলেন, “আমরা এর কিছুই জানি না বলায় আমার সই করা কাগজ দেখানো হল। বললাম, আমি তো পড়াশোনা জানি না। কাগজে কী লেখা, বুঝিনি। বলা হল, যেখান থেকে এসেছেন, এখন সেখানে ফিরে না গেলে পুলিশে দেওয়া হবে।”

এর পরে রাত দেড়টা নাগাদ ফের রোগীকে নিয়ে আর জি করে পৌঁছন মমতারা। কাগজে লিখিয়ে নেওয়া নিয়ে প্রতিবাদ করলে রোগী দেখতে রাজি হয় ওই হাসপাতাল। মমতা বলেন, “চিকিৎসকেরা তখন বলতে শুরু করেন, রোগীর পরিবারকে দিয়ে কাগজে লিখিয়ে না নিয়ে আমরা রেফার করে দিলে এমনিই ভর্তি নিত না। আমরা তো ভালর জন্যই চেষ্টা করেছিলাম।” এর পরেও অবশ্য ওই রোগীকে ভর্তি নেয়নি আর জি কর। শয্যা ফাঁকা নেই জানিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে কিছু ওষুধ দিয়ে ফের বুধবার যেতে বলা হয়। গত বুধবারও ভর্তি করানো যায়নি দীনুকে। এ বার তাঁর পায়ে প্লাস্টার করে ছেড়ে দিয়েছে হাসপাতাল। ফের সামনের বুধবার গিয়ে শয্যা ফাঁকা আছে কি না, দেখতে বলা হয়েছে। একটি জরুরি অস্ত্রোপচারও হওয়ার কথা দীনুর। সেটিও শয্যা পাওয়া গেলে তবেই হবে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল। দীনুর মেয়ে অপর্ণা বলেন, “টোটো চালিয়ে বাবা একাই সংসার টানতেন। এখন যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। দ্রুত চিকিৎসা না হলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। হাসপাতাল কি কিছুই করবে না?”

এই প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে বার বার ফোন করা হলেও ধরেননি আর জি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। বার বার ফোন কেটে দিয়েছেন ওই হাসপাতালের সুপার মানস বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দু’জনকেই টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েও কোনও উত্তর মেলেনি।

প্রায় একই অবস্থা নিমতার বছর পঁয়ষট্টির বিশ্বজিৎ চৌধুরীর। পরিজনদের দাবি, মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত বিশ্বজিৎবাবুকে নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাঁরা ঘুরছেন রেডিয়োথেরাপির তারিখ পেতে। গত বুধবার হাসপাতাল চত্বরে ট্রলিতে পড়ে থাকা সেই রোগীকে দেখে প্রশ্ন করতেই এক আত্মীয় বলেন, “কিছুতেই তারিখ পাচ্ছি না। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে হয়তো তারিখ মিলবে!”

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Government Hospital Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE