রবিবারের মানিকতলা বাজার। — নিজস্ব চিত্র
কলকাতার একটি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক রবিবার সকাল ১০টা নাগাদ পোস্টটা করলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। লিখলেন, ‘আজ বাজারের ভিড় দেখে মনে হল না, নিদারুণ অর্থ সঙ্কটে ভুগছেন লোকজন।’ তাঁর পোস্টে অন্তত পাঁচ জন কিছুক্ষণের মধ্যেই কমেন্ট করে জানালেন, তাঁদের অভিজ্ঞতাও এক।
দমদম কিংবা বাঁশদ্রোণী, মানিকতলা কিংবা গড়িয়াহাট, গত রবিবারের সঙ্গে তুলনা করলে এ দিন বাজারের ভিড় অবশ্যই বেশি ছিল। গত রবিবার ছুটির দিনের বাজার বলে বোঝাই যাচ্ছিল না। এতটাই খাঁ খাঁ করছিল মাছ, সব্জি, মুরগি ও মাংসের দোকান। সেই তুলনায় এ দিন বাজার কিছুটা হলেও গমগম করেছে। মাছের দোকানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছে, মাংসের দোকানে ছোট হলেও লাইন, অল্প ভিড় সব্জির দোকানেও। বাজার তার চেনা ছন্দে হয়তো ফেরেনি, কিন্তু পুরনো পাঁচশো ও হাজারের নোট বাতিলের পরে এই রবিবার খানিক বেড়েছে বেচাকেনার বহর।
তা হলে কি সত্যিই সঙ্কট কেটেছে?
মানিকতলা বাজারে মাছ কিনতে যাওয়া অরবিন্দ সরণির বাসিন্দা সনৎ ঘোষ কিন্তু বললেন, ‘‘আসলে গত রবিবার ব্যাঙ্ক খোলা ছিল। হাতে বৈধ নোট প্রায় কিছুই ছিল না। গত সোমবার আবার ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। তাই, ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়ানোটাই গত রবিবার ছিল সব চেয়ে জরুরি। বাজারমুখো হওয়াটা ছিল বিলাসিতা।’’ সনৎবাবুর কথায়, ‘‘গত সাত দিন ব্যাঙ্ক, এটিএম মিলিয়ে বেশ কিছু টাকা তুলতে পেরেছি। এ দিন ব্যাঙ্কও বন্ধ। তাই চাপমুক্ত হয়ে বাজারে গিয়েছিলাম।’’
গড়িয়াহাট বাজারে যাওয়া আর এক বৃদ্ধা দীপা রায় বললেন, ‘‘সোমবার থেকে তো ফের ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়াতে হবে। আজ তাই গোটা সপ্তাহের বাজার সেরে নিচ্ছি।’’ দমদমের প্রবীণ নাগরিক সঞ্জিত বিশ্বাস আবার জানান, একে হাতে তেমন নগদ ছিল না, তার উপরে টাকা জমা দেওয়া, তোলা এবং বদলাতে গিয়ে গোটা দিন লেগেছে। তাঁর কথায়, ‘‘যেটুকু ছিল, খরচ না করে রাখা ছিল। যদি বিপদ-আপদ হয়, সে কথা ভেবে। তার অতিরিক্ত টাকা হাতে আসায় আজ বাজারে গিয়েছি।’’
গত মঙ্গল থেকে শনিবার ক্রেতাদের অনেকেই ব্যাঙ্ক, এটিএম থেকে টাকা তুলতে পেরেছেন, টাকা বদলেছেন। সেই টাকা বাজারে ঢুকেছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাঙ্ক, এটিএমের সঙ্গে পাইকারি বাজার বা মহাজনের কাছেও বড় নোট ভাঙাতে পেরেছেন। বৈধ নোটের জোগান কিছু ছিল বলেই বাজার এ দিন ঝিমিয়ে পড়া ভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে।
বাঁশদ্রোণীর সব্জি ব্যবসায়ী বুদ্ধদেব পাল এ দিন ৭০ টাকা বাজার করেছেন, এমন খদ্দেরকেও ২০০০ টাকার নোটের ভাঙানি ১০০-র নোটে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বুদ্ধদেববাবু বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক আর আড়তদারের থেকে পাঁচটা ২০০০-এর নোট ১০০-র নোটে ভাঙিয়ে রেখেছিলাম বাজারের কথা ভেবে।’’
এক সপ্তাহ আগে যেমন থমকে যাওয়া অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে বাজার। সাধারণ মানুষের হাতে কিছু বৈধ নোট আসা ছাড়াও এর আর একটি কারণ আজ, সোমবার এই মরসুমে বিয়ের প্রথম দিন। বিয়ের আগের দিন পাত্রপাত্রী দু’জনের বাড়িতে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের সমাগম হয়, যাঁদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দু’বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা রাখেন গৃহকর্তা। বাঁশদ্রোণীর বাবু দাস এ দিন যেমন ৭০০ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি পাবদা বিক্রি করেছেন। দাম বেশি ছিল কাটা পোনারও।
খুচরো অনেক বাজারেই বেগুন ৫০ টাকা, সিম ৬০ টাকা, করলা ৫০ টাকা, গাজর ৬০ টাকা, বিনস ৮০-১০০ টাকা, কড়াইশুঁটি ১০০ টাকা কেজি দরে এবং বড় ফুলকপি এক-একটি ২০-২৫ টাকায় বিকিয়েছে। দাম বেশির কারণেও বাজার পুরো ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
নোট বদলের পরে প্রথম রবিবার, বিক্রি সাধারণ রবিবারের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম ছিল। এ দিন সে ঘাটতি ১৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেড় দশক ধরে গড়িয়াহাট বাজারে মাছ বিক্রি করা এক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, সাধারণত বিয়ের আগের দিন তত্ত্ব সাজানোর বরাত পান অন্তত আট-ন’টি। তবে আজ, সোমবারের বিয়ে উপলক্ষে একটিও তত্ত্ব সাজানোর বরাত পাননি!
মানিকতলা বাজারের মৎস্য বিক্রেতা আসগর আলির আক্ষেপ, ‘‘আগে রবিবার মানে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে গলদা, বাগদা সব ফুরিয়ে যেত। আজ অর্ধেকও বিক্রি হয়নি।’’ বিয়ের মরসুমে মানিকতলা বাজারে খাসির মাংসের বরাত সব চেয়ে বেশি পান মহম্মদ রফিক। এ দিন তিনি বললেন, ‘‘সাধারণত বিয়ের আগে ২০টা বাড়ির অর্ডার পাই। এ বার কোনও অর্ডারই নেই। শুধু খুচরো বিক্রি।’’ সেই তুলনায় ভিড় বেশি ছিল মুরগির দোকানে। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘‘নতুন পাঁচশোর নোট পুরোদস্তুর বাজারে এলে বাজার আরও চাঙ্গা হবে।’’
নোট বদলের পরে প্রথম রবিবারের বাজার মূলত ভুগেছিল বৈধ নোটের অভাবে। আর দ্বিতীয় রবিবার বাজারে বৈধ নোট কিছু ঢুকল ঠিকই, তবে তার মধ্যে অনেকগুলি ২০০০-এর। যার খুচরো পেতে সমস্যা।
যে কারণে বিয়ের মরসুমে যখন মিষ্টির বিক্রি বেড়ে যায়, তখন সব দোকানেরই বিক্রি গড়ে ২০-৩০ শতাংশ কমেছে। বেশির ভাগ দোকানেই কার্ডে দাম মেটানোর ব্যবস্থা নেই। রিষড়ার এক সাবেক মিষ্টির দোকানের কর্ণধার অমিতাভ মোদকের কথায়, ‘‘নোটের আকালে মিষ্টি বিলাস বেশ ধাক্কা খেয়েছে। বিয়ের বড় অর্ডার মিষ্টির দোকানের অক্সিজেন। তাতেই ঘাটতি।’’ উত্তর কলকাতার সিমলের সন্দেশ বিপণির কর্তা পার্থ নন্দী বলে দিচ্ছেন, ‘‘অনলাইনে আমাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিন। অর্ডার দোকান থেকে বেরোনোর আগে কিন্তু টাকা ঢোকা চাই।’’ আর এক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সৌমেন দাশ জানাচ্ছেন, বড় অর্ডারের টাকা চেকে মেটানোর প্রবণতা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে নোটের আকালে।
খুচরো হাতে পেতে মানুষের উদ্যম এ দিনও দেখার মতো। দমদম স্টেশন লাগোয়া বাজার থেকে কেনাকাটা সেরে বাড়িতে থলে ফেলেই কয়েক জনকে একটি ব্যাঙ্কের এটিএমে লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেল। টাকা নেই। তবু লাইনে দাঁড়ানোর কারণ, তাঁরা খবর পেয়েছেন, একটু পরেই ক্যাশ ভ্যান ঢুকবে আর তাতে আসবে প্রচুর একশোর নোট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy