Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফোন রাখুন, তবেই ট্রলি

সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গিয়ে ট্রলি পাওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লটারি পাওয়ার সমান। অনেক সাধ্য-সাধনা করে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের একাংশকে আর্থিক গচ্চা দিয়েও বহু সময়ে ট্রলি মেলে না।

অব্যবস্থা: অনেক চেষ্টাতেও জোটানো যায়নি ট্রলি। অগত্যা এ ভাবেই রোগীকে নিয়ে যাচ্ছেন পরিজনেরা। ন্যাশনাল মেডিক্যালে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টচার্য।

অব্যবস্থা: অনেক চেষ্টাতেও জোটানো যায়নি ট্রলি। অগত্যা এ ভাবেই রোগীকে নিয়ে যাচ্ছেন পরিজনেরা। ন্যাশনাল মেডিক্যালে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টচার্য।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৭ ১৩:০০
Share: Save:

ট্রলি মিলতে পারে। কিন্তু, যত ক্ষণ তা রোগীর পরিবারের হেফাজতে থাকবে, তত ক্ষণ পরিবারের কারও মোবাইল জমা রাখতে হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিরাপত্তাকর্মীর কাছে। দিনের পর দিন এমনই ঘটছে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও নির্দেশ জারি হয়নি ঠিকই। তবে তাঁরা বিষয়টি জানেন না, এমন নয়। কর্তৃপক্ষের একাংশ বরং জানিয়েছেন, রোগীর পরিবার বহু সময়েই ট্রলি নিয়ে তা যেখানে সেখানে রেখে দেন। তাই কোনও কোনও বিভাগে এমন ‘বিনিময় প্রথা’ চালু হয়েছে। এমনকী, এতে ভাল ফল মিলছে বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। যদিও হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।

সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে গিয়ে ট্রলি পাওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লটারি পাওয়ার সমান। অনেক সাধ্য-সাধনা করে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের একাংশকে আর্থিক গচ্চা দিয়েও বহু সময়ে ট্রলি মেলে না। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠে আকছার। কিন্তু মুমূর্ষু রোগীকে ভর্তি করতে গিয়ে মোবাইল জমা রাখার এমন ব্যবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকেই। স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারাও বিষয়টি জেনে স্তম্ভিত। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘এ রকম যে ঘটতে পারে, সেটাই ভাবতে পারছি না। আর জি কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলব। অসুস্থ মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ, কখনওই চলতে পারে না।’’

সম্প্রতি আর জি করে ট্রলি নিয়ে এমন একটি ঘটনার পরে বিষয়টি স্বাস্থ্যকর্তাদের নজরে আসে। পায়ের হাড় ভাঙায় উঠতেই পারছেন না, এমন এক বৃদ্ধাকে হাবরা হাসপাতাল থেকে আর জি করে স্থানান্তরিত করা হয় দিন কয়েক আগে। অ্যাম্বুল্যান্স থেকে স্ট্রেচারে করেই রোগীকে বহির্বিভাগে নিয়ে যান আত্মীয়েরা। সেখানে অনেক টালবাহানার পরে অস্থি বিভাগে ভর্তি করতে না পেরে তাঁকে ভর্তি করা হয় জেনারেল মেডিসিন বিভাগে।

এ বার বহির্বিভাগ থেকে মেডিসিন ওয়ার্ডে ট্রলি পেতে আর এক বিড়ম্বনা। ট্রলি নিয়ে গিয়েছেন অন্য কেউ। সেখানে দাঁড়াতে হল লাইনে। ঘণ্টাখানেক বাদে ট্রলি মিলল। তবে বিনিময়ে জমা দিতে হল মোবাইল। রোগীর এক আত্মীয় কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘‘মোবাইল দিতে হবে? বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন। ফোন আসছে।’’ হাসপাতালের কর্মীর পাল্টা জবাব, ‘‘তা হলে আধার কার্ড দিন। ফোন রেখে কী হবে? হাসপাতালে তো নেটওয়ার্কও থাকে না।’’ অগত্যা বাধ্য হয়েই ফোন জমা দিয়ে নিতে হল ট্রলি।

কিন্তু ট্রলি নিয়ে কী হবে? তার চাকাই তো ঘোরে না! অথচ, রোগীকে নিতে হবে ছ’তলার মেডিসিন ওয়ার্ডে। ট্রলি ঠেলার জন্য ওয়ার্ড বয় নেই। বাধ্য হয়েই ট্রলি নিয়ে যেতে হল রোগীর পরিজনকেই। পরদিন মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে অস্থি বিভাগে ট্রলি নিয়ে যেতে আবার আর এক সমস্যা। মেডিসিনে ৩০০ রোগীর জন্য একটিই ট্রলি রয়েছে, জানালেন নার্সরা। সেই ট্রলি নিয়ে যাওয়া যাবে না।

অনেক অনুনয়-বিনয় করে ঘণ্টাখানেক বাদে শুধু নীচে নামানোর জন্য মিলল ট্রলিটি। এ বার ট্রলির বিনিময়ে রোগীর চিকিৎসার সমস্ত কাগজপত্র জমা রেখে দিলেন নার্সরা। ট্রলি করে রোগীকে অস্থি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই কাগজপত্র না পেলে রোগী দেখা যাবে না। অগত্যা ওই বৃদ্ধাকে কোনওমতে চাদর ধরে নীচে নামিয়ে ট্রলি উপরে ফেরত দিতে ছুটলেন বাড়ির লোকেরা। মেডিসিন ওয়ার্ডে ট্রলি বুঝে নেওয়ার পরে কাগজপত্র ফিরিয়ে দিলেন নার্স। সেই কাগজপত্র নিয়ে অস্থি বিভাগে আর এক প্রস্ত সাধ্য-সাধনার পরে সেখানকার ট্রলিতে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হল ওয়ার্ডে। ওই বৃদ্ধার ছেলে গৌতম করের কথায়, ‘‘বড় হাসপাতালে মা ঠিক হয়ে যাবেন বলে হাবরা হাসপাতাল থেকে মাকে ‘রেফার’ করা হয়েছিল। কিন্তু এই হয়রানির কথা ভাবতেই পারিনি।’’

ট্রলি নিয়ে এমন হয়রানি যে প্রতি দিন প্রায় সমস্ত হাসপাতালেই হয়, তা স্বীকার করে নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। তাঁদের বক্তব্য, আলাদা ট্রলি ব্যুরো তৈরি করেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বিকল্প পথের সন্ধান চলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE