Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

‘মেয়ের’ জন্মদিন, সাজল হাসপাতালের ঘর

গর্ভধারিণী মা এক বছর আগে ছুটকিকে হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ের প্রথম জন্মদিন ছিল শনিবার। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য ছাপানো আমন্ত্রণপত্রে ছুটকিকে এ ভাবেই তার ‘পরিচয়’ উপহার দিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এসএনসিইউ বিভাগ।  

উদ্‌যাপন: কার্ড (বাঁ দিকে) ছাপিয়ে পালন করা হল ছুটকির জন্মদিন। শনিবার, আর জি করে। নিজস্ব চিত্র

উদ্‌যাপন: কার্ড (বাঁ দিকে) ছাপিয়ে পালন করা হল ছুটকির জন্মদিন। শনিবার, আর জি করে। নিজস্ব চিত্র

সৌরভ দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:০১
Share: Save:

‘জানো আমি কে? আমি ছুটকি। আর জি কর হাসপাতালের এসএনসিইউ কর্মীদের মেয়ে’!

গর্ভধারিণী মা এক বছর আগে ছুটকিকে হাসপাতালে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। সেই মেয়ের প্রথম জন্মদিন ছিল শনিবার। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের জন্য ছাপানো আমন্ত্রণপত্রে ছুটকিকে এ ভাবেই তার ‘পরিচয়’ উপহার দিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এসএনসিইউ বিভাগ।

গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর ফুটফুটে এই কন্যাসন্তান প্রসব করেছিলেন রাজারহাট-গোপালপুরের বাসিন্দা পুষ্প মণ্ডল। হাসপাতালের নথিতে নিজের ওই নামই লিখেছিলেন ছুটকির জন্মদাত্রী মা। এর পরে এক মাসের মাথায় মেয়েকে হাসপাতালের বিছানায় ফেলে পুষ্প নিরুদ্দেশ হয়ে যান। সেই থেকে এই সরকারি হাসপাতালের এসএনসিইউ বিভাগে সিস্টার ইন-চার্জ পুনম দাস এবং তাঁর সহকর্মী অনুজা কোলে, লাভলি খাতুন, মনোয়ারা খাতুন, পম্পা মণ্ডলের কোলে কোলেই বেড়ে উঠছে ছুটকি। এ দিন সেই ছুটকির জন্মদিন উপলক্ষে এসএনসিইউ বিভাগকে পার্টির সাজে সাজিয়ে তুলেছিলেন ওই শিশুকন্যার ‘মামমামেরা’। চোখের আড়াল হলে ওই নামেই পম্পাদের ডাক দেয় ছুটকি। পম্পার কথায়, ‘‘বেড থেকে ঝুঁকে আমাদের ডাকতে থাকে।’’

জন্মদিনের কেক হয়েছিল এক কার্টুন চরিত্রের আদলে। আমন্ত্রণপত্রের খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে খেয়াল ছিল পুনমের। মোমবাতি নিভিয়ে কেক কাটার পরে ছিল ভাত, ডাল, তিন রকমের ভাজা, দু’রকমের মাছ, চাটনি এবং মিষ্টিমুখের আয়োজন। চারপাশে রং-বেরঙের বেলুনের মাঝে নতুন পোশাকে এ দিন ছোট্ট ছুটকি একেবারে ভিআইপি। আজ যে তারই দিন, হাবভাবে তা যেন কিছুটা বুঝিয়েও দিচ্ছিল একরত্তির মেয়েটি। তা দেখেই আরও আকুল হয়ে উঠছিল ‘মামমামদের’ মাতৃত্ব।

মনোয়ারা এ দিন বলেন, ‘‘পাশ দিয়ে গেলেই হাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চায়। এখন তো আবার হাত নেড়ে টাটা করতেও শিখেছে। ও কিন্তু খুব অভিমানী!’’ এই আহ্লাদ এসএনসিইউ বিভাগে তারই মতো আরও দুই শিশুকে ঘিরেও। মাস চারেক আগে দমদমের আমবাগানে বালির স্তূপ থেকে এক শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত শিশুকন্যার গায়ে একটি কুকুর আঁচড়াচ্ছে দেখে তাকে উদ্ধার করেছিলেন স্থানীয়েরা। সে কিংবা তারই মতো গত বছর এপ্রিলে হাসপাতালে ফেলে যাওয়া পুত্রসন্তান তার আদরে ভাগ বসালে ছুটকির একটু অভিমান হয় আর কী! দিদির জন্মদিনে নতুন জামা, খেলনা উপহার পেয়েছে ওই দুই খুদেও।

সম্প্রতি লেক টাউন থানার পুলিশ ওই পুত্রসন্তানের মাকে পাওয়া গিয়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট না-পাওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মহিলার হাতে এসএনসিইউ বিভাগ তাকে তুলে দিতে রাজি নয়। পুত্রসন্তানের ভবিষ্যৎ যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।

এ দিন এসএনসিইউ বিভাগের প্রধান, শিক্ষক-চিকিৎসক গোবিন্দচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘আয়োজন বড় কথা নয়, কাজের জায়গায় এই পরিবারটাই বড় প্রাপ্তি।’’ আর এক শিক্ষক-চিকিৎসক শিবনাথ গায়েন বলেন, ‘‘এই শিশুদের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে।’’

তবে কিছুটা উদ্বেগও রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, আগে যে সব সদ্যোজাতের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যেত না, তাদের হাসপাতালে আনার তিন-চার মাসের মাথায় হোমে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হত। এখন তা ব্যাহত হচ্ছে। সদ্যোজাতদের চিকিৎসার দিকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি ছুটকিদের যত্ন নেওয়ার কাজ সহজ নয়। তা ছাড়া হাসপাতাল থেকে যাতে কোনও সংক্রমণ না হয় ছুটকিদের, সেটাও নিশ্চিত করা জরুরি।

এ সবের কিছুই বোঝে না ছুটকি। তার জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রের শেষ দু’লাইনেও লেখা, ‘জানি না, আমার ভবিষ্যৎ কী? কিন্তু আমাকে তোমাদের মেয়ে হয়েই থাকতে দাও’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Birthday Girl RG kar Hospital SNCU Unit
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE