Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

আমাকে আমার মতো চলতে দাও

গৌরীবাড়িতে শুক্রবার বেপরোয়া অটো-দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় কলেজছাত্রী পূজা পালের। তার পরে একটুও কি বদলেছে ছবিটা? চৈতন্য কি ফিরেছে শহরের অটোচালকদের? শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখলেন কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী, তিয়াষ মুখোপাধ্যায়, তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীক্ষা ভুঁইয়া।সকাল ১০:১৫। অরবিন্দ সরণিতে সবুজ হল উল্টোডাঙা থেকে হাতিবাগানের দিকে যাওয়ার সিগন্যাল। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে স্বাভাবিক ভাবেই তখন বেলেঘাটা আই ডি থেকে আর জি কর হাসপাতালমুখী আড়াআড়ি রাস্তাটির সিগন্যাল লাল।

হাতিবাগান

হাতিবাগান

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:১৯
Share: Save:

গাড়ি সিগন্যাল মানে না

সকাল ১০:১৫। অরবিন্দ সরণিতে সবুজ হল উল্টোডাঙা থেকে হাতিবাগানের দিকে যাওয়ার সিগন্যাল। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে স্বাভাবিক ভাবেই তখন বেলেঘাটা আই ডি থেকে আর জি কর হাসপাতালমুখী আড়াআড়ি রাস্তাটির সিগন্যাল লাল। কিন্তু অটোর গতি দেখে সিগন্যালের হিসেব মেলানো মুশকিল। সবুজ আলো দেখে গতি বাড়ানো বাস-গাড়ি-লরির সামনে দিয়েই বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি ভর্তি রাস্তাটি পেরিয়ে গেল একটি অটো। নম্বর, ডব্লিউবি ০৪/এফ ৬৬৬৮। শনিবার সকালে গৌরীবাড়ি মোড়ের দৃশ্য ঠিক এমনটাই। দেখে বোঝার উপায় নেই, শুক্রবার এই মোড়েই অটোর বেপরোয়া মনোভাবের মাসুল দিয়েছেন ১৮ বছরের পূজা পাল। তার পরে পেরিয়েছে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। কিন্তু ছবি একই, শুক্রবারের মরণ-গতিরই ‘রিপিট টেলিকাস্ট’। একচুলের জন্য হয়তো ঘটল না দুর্ঘটনা। তবু নির্বিকার ভাবে ট্রাফিক সিগন্যাল ভেঙেই চলেছেন অটোচালকেরা।

বেলা ১১:০০। হাতিবাগান মোড় অন্য দিনের তুলনায় অনেকটাই ফাঁকা। একে শনিবার, তার উপরে বিশ্বকর্মা পুজো। সব মিলিয়ে ছুটির মেজাজে বাস-অটোর সংখ্যা বেশ কমই। তবে যে ক’টি আছে, তাদের দৌরাত্ম্য কম নয়। শ্যামবাজার থেকে বিবেকানন্দ রোডের দিকে যাওয়ার রাস্তায় সিগন্যাল সবুজ হতেই গতি নেয় সেই রাস্তার গাড়িগুলি। কিন্তু তখন অরবিন্দ সরণি থেকে শোভাবাজার যাওয়ার রাস্তার লালবাতির নিষেধ মানতে মোটেই রাজি নন অটোচালকেরা। এগিয়ে আসা বাসের সামনে দিয়েই হুশ করে বেরিয়ে গেলেন দিব্যি। পিছনের আসনে বসে থাকা যাত্রী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘আরে, করছেন কী! মারবেন নাকি!’’ এ সবে পাত্তা দিলে চলে! শোভাবাজারের দিকে ছুটল অটো। এটা কিন্তু মোটেই ব্যতিক্রমী অটো নয়। প্রতি বার সিগন্যাল খোলা ও বন্ধের সময়ে প্রায় সব ক’টি অটোই একই রকম বেপরোয়া।

বেলা ১১:৩০। গড়িয়া বাসস্ট্যান্ডের মোড়ে দক্ষিণের দিক থেকে আসা অটোগুলি রাস্তার মাঝখান থেকে সাঁ সাঁ করে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে স্ট্যান্ডে ঢুকবে বলে। হঠাৎ ব্রেক কষে থামছে উল্টো দিক থেকে আসা বাস, লরি, ট্যাক্সি, গাড়ি। সিগন্যাল অবশ্য আছে, কিন্তু মানার বালাই নেই। নেই কোনও বাধাও। আর একটু এগিয়েই দেখা গেল, সোনারপুরের দিক থেকে আসা অটোগুলোও একই ভাবে ইউ-টার্ন নিচ্ছে স্ট্যান্ডে যাবে বলে। অথচ ঠিক মাথার উপরেই জ্বলজ্বল করছে বোর্ড, ‘নো ইউ-টার্ন’। বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পেরিয়ে গেল ডব্লিউ বি ১৯/এফ ৭৯৮৮।

বেলা ১১:৪৫। সল্টলেক, গড়িয়া থেকে আসা গাড়িগুলি জোর গতিতে নেমে আসছে মা উড়ালপুল থেকে। পার্ক স্ট্রিটমুখী রাস্তা ধরবে সেগুলি। যারা চাঁদনি চক বা শিয়ালদহের দিক থেকে আসছে, লালবাতির মুখে পড়ে তাদের মধ্যে থেমে গিয়েছে অনেকেই। এরই মধ্যে সব কিছু উপেক্ষা করে একটি অটো ঢুকে পড়ল চলন্ত গাড়ির মিছিলে। তাতে অন্য গাড়িগুলির গতি গেল কমে। বেপরোয়া অটোটি একে ওকে পাশ কাটিয়ে দিব্য পেরিয়ে গেল রাস্তা। পৌঁছলো পার্ক সার্কাসের ইসলামিয়া মেডিক্যাল সেন্টারের সামনের স্ট্যান্ডে। পুলিশ ছিল, কিন্তু তার ছাপ পড়ল না অটোচালকের আচরণে। কারণ, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে উড়ালপুলের নীচে পিলারের ঘেরাটোপের মধ্যে জড়ো হয়ে গল্প করছেন পুলিশকর্মীরা।

দুপুর বারোটা। টালিগঞ্জ ফাঁড়ি মোড়। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের সিগন্যালটি ছাড়তেই এক সঙ্গে সাত আটটি যাদবপুর-রবীন্দ্র সরোবর রুটের অটো জোর গতিতে বাঁক ঘুরে রীতিমতো রেষারেষি শুরু করল। কারণ টালিগঞ্জ ফাঁড়ির সিগন্যাল খোলা রয়েছে। ফলে যত তাড়াতাড়ি ওই সিগন্যালটা পেরিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু সিগন্যালের কয়েক মিটার আগেই অটোগুলি পৌঁছতে না পৌঁছতে সিগন্যালের রং বদলে যায়। তাতে কী? কিছু পরোয়া না করেই দু’টি অটো সিগন্যাল ভেঙে বেরিয়ে গেল। কোনও ট্রাফিক সার্জেন্ট নেই।

দুপুর বারোটা। রাজাবাজার মোড়ের সিগন্যাল লাল। তার মধ্যেই দিব্য এগিয়ে চলেছে মেছুয়া থেকে ফুলবাগানের দিকে যাওয়ার অটো। ও দিকে কিন্তু শিয়ালদহ থেকে মানিকতলার দিকে যাওয়ার রাস্তায় সবুজ সিগন্যাল হতেই বাসগুলি গতি বাড়াচ্ছে। আর চলন্ত বাসের সামনে দিয়েই এঁকেবেঁকে যাত্রী-সহ এগিয়ে যাচ্ছে অটোর দল। সিঁটিয়ে রয়েছেন যাত্রীরা। ঠিক এ ভাবেই শুক্রবারের দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল কলেজপড়ুয়া পূজা পালের প্রাণ।

গড়িয়া মোড়

তেঁতুল পাতায় ক’জন

বেলা ১০:৪৫। চার জন যাত্রী নিয়ে নিয়ম মেনে যাদবপুর থেকে ছাড়ল ইএম বাইপাস হয়ে গড়িয়া স্টেশন যাওয়ার অটো। সুকান্ত সেতুর মাঝামাঝি পৌঁছতেই ডান দিকের রড খুলে সটান পঞ্চম যাত্রীকে তুলে নিলেন চালক। জিজ্ঞেস করতেই উত্তর, ‘‘ইনি তো সামনেই নেমে যাবেন।’’

বেলা ১১:৪৫। গড়িয়া থেকে একের পর এক অটো ছাড়ছে কামালগাজি, সোনারপুর, বারুইপুর রুটে। ছুটির দিন, তবু লাইন নেহাত কম নয়। তবে আট বছরের শিশু থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধা, সকলের জন্যই এক নিয়ম। পিছনের তিন জনের আসন ভর্তি হয়ে গেলে সামনে চালকের বাঁ দিকে বসছেন দু’জন করে। চালকের পাশে এক জন বসার পর বয়স্কা মহিলা ছিলেন লাইনে। ষষ্ঠ আসনে ও ভাবে বসতে চাননি তিনি। সমাধান করে দিলেন চালক নিজেই। তাঁর ‘আদেশে’ পিছন থেকে এক তরুণ উঠে চলে এলেন সামনের সিটে। মহিলার জায়গা হল পিছনে। পাঁচ জনকে নিয়ে দিব্যি চলল অটো।

দুপুর বারোটা। ফুলবাগান-মেছুয়া রুটের অটো। শহরের বুকে দিব্যি বেনিয়মে চলেছেন তারা। অবাধে। এ দিন দেখা গেল, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো অটোর ভিতরে কান ফাটানো গান বাজছে। চালকের বাঁ পাশে দু’জন বসেছেন। দু’জন বলা ভুল, কারণ এক জনের শরীরের অর্ধেক অংশ বাইরে ঝুলছে। চালকের পিছনের সিটে তিন জন। তাঁদের মধ্যে কেউ শিশু কোলে, কেউ আবার গুঁতোগুতি করে ঢুকিয়েছেন একটা বড় কাপড়ের পুঁটুলি। নিয়মানুযায়ী চালকের বাঁ পাশের আসনে এক জনেরই বসার কথা। সিগন্যালে যখনই অটো দাঁড়াচ্ছে, তখন বাইরের দিকে ঝুলন্ত যাত্রী যেন একটু হাঁফ ছাড়ছেন। ডব্লিউবি ০৪/এফ ২০৮৯— এমনটাই হল। রুটের সমস্ত অটোই এই একই খেল দেখিয়ে চলেছে।

যেতে পারি, কিন্তু...

বেলা ১১:৩০। গড়িয়া থেকে বারুইপুর যাওয়ার অটো।

কোথায় যাবেন?

বারুইপুর।

যাবে না।

কেন?

লং রুট নেব না।

এটা তো লং রুটেরই অটো। যাবে না বারুইপুর?

যাবে। কিন্তু এখান থেকে টানা বারুইপুর যাবে না। শর্ট রুটের লোক নিতে নিতে যাবে।

বেলা ১১:৩৫। অটো থামল পার্ক সার্কাসের ইসলামিয়া মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে। এক ঝাঁক যাত্রী ছুটছেন সেখানে জায়গা পেতে। গাড়ি যাওয়ার কথা চাঁদনি চক পর্যন্ত। কিন্তু চালক জানিয়ে দিলেন, বাটা মোড় পর্যন্ত যাবেন। কয়েক জন কারণ জানতে চাইতেই রাস্তায় পানের পিক ফেলে চালকের সাফ উত্তর, ‘‘জল জমেছে। যাব না।’’

রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিট

আগে কে

দুপুর ১২:৩০: শনিবারের নিমতলা ক্রসিং যেন অটো-প্রতিযোগিতার ট্র্যাক। আগে যাওয়ার দৌড় চলছে অটোগুলির মধ্যে। মানিকতলার দিক থেকে আসা অটোগুলি নিমতলা ক্রসিং পার করার আগেই শুরু করছে দৌড়। কারণ ক্রসিং পার করেই স্ট্যান্ড। সেখান থেকেই ফের মানিকতলায় যাওয়ার অটোর লাইন শুরু। তাই কোন অটো প্রথমে লাইনের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে অটোচালকদের মধ্যে এক অঘোষিত লড়াই চলে সর্বক্ষণ। ডান দিক-বাঁ দিক না দেখেই একে অপরকে টেক্কা দিতে এগিয়ে যায় তারা। কোন দিক থেকে বাস আসছে, কোন গাড়িই বা ইউ টার্ন নিচ্ছে, নিমতলার ক্রসিং এলে অটো চালকদের সে সব দেখার সময় নেই।

গান চলবেই, নেমে যান

বেলা ১১:১৫। পার্ক সার্কাস সাত মাথা মোড়ে উড়ালপুলের দিক থেকে ধেয়ে নেমে আসছে গাড়ির পর গাড়ি। একই সঙ্গে বাকি পাঁচ মাথায় গাড়ির জটলা। সিগন্যালের অপেক্ষা। দু’একটা অটো এসে থামছে। যাত্রী বোঝাই করে ছুটছে চাঁদনি চকের দিকে। কয়েকটি অটোর ভিতরে লাল নীল ঝিকমিক আলো-সহ তারস্বরে বাজছে গান। এক যাত্রী ফোন-কানে অটোতে উঠে চালককে অনুরোধ করলেন, গানটা একটু আস্তে করে দিতে। অমনি বিগড়ে গেল চালকের মেজাজ। সরাসরি যাত্রীকে বলে দিলেন, ‘‘গান থামবে না, চলবে। নেমে যান। গাড়ি যাবে না।’’ কিছুক্ষণ তর্ক করলেও লাভ হল না। ঔদ্ধত্যের মুখে হার স্বীকার করে নেমে গেলেন যাত্রী।

তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই পরের অটোর জন্য অপেক্ষা শুরু হল তাঁর। সেই গান বাজা অটোটিতে অন্য যাত্রী উঠে বসেছেন তত ক্ষণে। সেটি চলে গেল চাঁদনি চকের দিকে।

সরকারি বিধির তোয়াক্কা নেই। নিজেদের ‘নিয়ম’ নিজেরাই তৈরি করে নেন এ শহরের অটোচালকেরা। আনন্দবাজারের ক্যামেরায় ধরা পড়ল বেনিয়মের এমনই নানা দৃশ্য। কোথাও রাস্তার মোড়ে ইচ্ছেমতো দিক বদল করছে অটো। কোথাও নিষেধ সত্ত্বেও অবলীলায় ‘ইউ টার্ন’ নেওয়া চলছে। কোথাও আবার বাসকে পাশ কাটিয়ে ঝুঁকির দৌড়। শনিবার ছবিগুলি তুলেছেন স্বাতী চক্রবর্তী ও শশাঙ্ক মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Auto drivers traffic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE