আমাদের পাড়াটা যেন ভারতবর্ষের একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ! নানা বর্ণ নানা জাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আপাতদৃষ্টিতে ঝাঁ-চকচকে নয় ঠিকই, বাইরে থেকে দেখে মনে হয় কিছুটা বিবর্ণ, মলিন, ঘিঞ্জি। তবে এখানে বসবাস করলে বোঝা যায় পাড়াটা কত বর্ণময় আর বৈচিত্রে ভরা। আমাদের কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের ব্যাপ্তি বিধান সরণির কলেজ স্ট্রিট বাটার পাশ থেকে শুরু করে রাজাবাজার মোড়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড পর্যন্ত। মাঝখান দিয়ে গিয়েছে আমহার্স্ট স্ট্রিট। এর মাঝে শাখা-প্রশাখা নিয়ে পাড়াটার অবস্থান।
পাড়া মানে কিন্তু শুধু থাকার জায়গা নয়। নিজের পেশা ও পরিবারের বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মেলামেশা, সুখ-দুঃখে পাশে থাকা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে টিকিয়ে রাখাটাও পাড়ার মধ্যেই পড়ে। পাড়াটা একটা বৃহত্তর চরিত্র। এর ভালমন্দের উপরে নির্ভরশীল তার বাসিন্দাদের ভালমন্দ।
এ পাড়ায় ভোর হয় আজানের সুরে। রাস্তার কলে বড় বড় বাসন ধোওয়ার আওয়াজ, ট্যাক্সি ড্রাইভারদের আলাপচারিতা, ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের ক্ষণিকের আড্ডা। এটাই ভোরের পরিচিত ছবি। ভৌগোলিক ভাবে দেখলে এ পাড়াটা মধ্য কলকাতা ও উত্তর কলকাতার সংযোগস্থল। বরাবরই এ অঞ্চলে দেখা যায় মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব।
আগে এখানে থাকতেন মূলত মধ্যবিত্ত হিন্দু ও মুসলমানরা। ক্রমেই ব্যসায়ীদের সংখ্যা বাড়ায় এটা হয়ে উঠেছে একটা বাণিজ্যিক পাড়া। কাছেই কলেজ স্ট্রিট। বই বাঁধানো, বই ছাপার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে পাড়াটা। আছে জুতোর দোকান, প্লাস্টিকের কারখানাও। আমাদের আবাসনের উল্টো দিকের বস্তিটায় বহু মানুষ চটি তৈরি করেন যা বহু নামী দোকানে সরবরাহ করা হয়। এ পাড়ায় বসে প্রতি মুহূর্তে লক্ষ করা যায় সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন। বহুতলের পাশাপাশি প্রমোটারের থাবা বাঁচিয়ে টিকে থাকা বাড়িগুলি যেন কালের প্রহর গুনছে। বেড়েছে রাস্তার দু’ধারে দোকানের সংখ্যাও।
আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে এ পাড়ার নাগরিক পরিষেবা। বসেছে জোরালো আলো, রয়েছে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থাও। তবে কিছু আক্ষেপও আছে প্রিয় পাড়াটাকে নিয়ে। বর্ষায় জল জমা এখনও বাসিন্দাদের কাছে বিভীষিকা। এক এক সময় তো দু’তিন দিন লেগে যায় জল নামতে। তেমনই দিনে এক বার জঞ্জাল সাফাই হলেও সারা দিনে জমতে থাকা আবর্জনা রাতে ব্যাপক আকার নেয়। তা ছাড়া কিছু মানুষের মধ্যে নাগরিক সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেক ফুটপাথ হয় দখল হয়েছে না হয় ভেঙে গিয়েছে। সেখান দিয়ে আর হাঁটাই যায় না। এ জন্যই বেশির ভাগ মানুষকে রাস্তায় নেমে হাঁটতে হয়। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে যানজট। এক দিকে কলেজ স্ট্রিট, অন্য দিকে, রাজাবাজারের অবস্থানের জন্য এক এক সময় পাড়াটা যানজটে জেরবার হয়ে যায়। তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে রাস্তার দু’ধারে গাড়ির পার্কিং।
কর্মব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন সেটা গ্রাস করতে পারেনি পাড়ার আড্ডাটাকে। আমাদের আড্ডা বসে কখনও রকে কখনও বা বন্ধুর বৈঠকখানায়। পাড়ার পাশাপাশি আড্ডা বসে নববিধানের সামনে, আমহার্স্ট স্ট্রিটের পদ্ম রেস্তোরাঁ বা সুকিয়া স্ট্রিটের রবির চায়ের দোকানে। এক এক সময় মনে হয় এই আড্ডাটা আছে বলেই মানুষে মানুষে খোঁজ রাখার অভ্যাসটা হারিয়ে যায়নি।
তেমনই বিপদে আপদে এখনও এলাকার মানুষ পাশে দাঁড়ান। একটা ঘটনা বলি। এক বার ট্রান্সফর্মার ফেটে আগুন লেগেছিল আমাদের বহুতলের একটি জানালায়। তখন সামনের বস্তির অসংখ্য মানুষ বেরিয়ে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য। শুধু তাই, নয় পাড়ার যুব সম্প্রদায় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যে কোনও সমস্যায় পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
ছবি:শুভাশিস ভট্টাচার্য
এ পাড়ার দুর্গাপুজো-কালীপুজো কিংবা ইদ্, মহরম সমান আকর্ষণীয়। রয়েছে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি। এ পাড়ায় ভালই ছিল খেলাধুলোর চল। কাছেই হৃষিকেশ পার্কে পাড়ার অনেকেই খেলতে যেতেন। এখন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে খেলাধুলোর চলটা কমেছে। কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে কলেজ স্ট্রিট বাজার, শ্রীমানি বাজার। তবে ভোজন রসিকদের সেরা ঠিকানা মানিকতলা বাজার।
এক এক সময় এ পাড়াটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শিহরণ বোধ করি, যখন মনে পড়ে যায় এ পাড়া দিয়েই এক দিন হেঁটে গিয়েছেন বাংলার নবজাগরণের প্রাণপুরুষরা। কাছেই নববিধান ব্রাহ্মসমাজ। কেশবচন্দ্র সেনের স্মৃতি বিজড়িতও এই অঞ্চল। ও দিকে রাজা দিগম্বর মিত্র ও শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতি জড়ানো ঝামাপুকুর রাজবাড়ি। রয়েছে বহু পুরনো শিবমন্দিরটি। মনে পড়ে ছোটবেলায় রাজাবাজার মোড় থেকে ঘোড়ার গাড়ি চেপে হাওড়া স্টেশনে যেতাম। রাজাবাজার মোড়ে এখন কিছু শৌখিন ঘোড়ার গাড়ি দেখা যায় যেগুলি ব্যবহার হয় বিয়ে এবং পুজো-পার্বণের শোভাযাত্রায়। আমাদের পাড়ায় একজন দুধ বিক্রেতা আছেন যিনি এখনও ঘোড়ার গাড়ি করে বিভিন্ন দোকানে দুধ সরবরাহ করেন। তাই নতুনের মাঝে আজও মেলে পুরনোর কিছু ঝলক।
এক সময় আশপাশের মধ্যে থাকতেন বেশ কিছু চিকিৎসক যাঁরা রাত-বিরেতে যে কোনও সময় ডাক পড়লেই রোগীর বাড়ি যেতেন। তাঁদের মধ্যে সুকান্তি হাজরা, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় ঘোষ, নারায়ণ রায়ের কথা আজও মনে পড়ে।
এ বাড়িতে বছর পাঁচেক বসবাস। তবে জন্ম থেকেই এ অঞ্চলটার সঙ্গে নিবিড় যোগায়োগ। ছেলেবেলা কেটেছিল বাদুড়বাগান স্ট্রিট ও বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে। তার পরে বেশ কিছু বছর কলকাতার বাইরে কাটিয়ে ফিরেছিলাম দক্ষিণ কলকাতায়। তবে এ অঞ্চলের প্রতি বরাবরই টান অনুভব করতাম। সেই টানে আর বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে আবারও এখানেই ফিরে এলাম।
এ পাড়াটাই আমাকে দিয়েছে জীবনের একঘেয়েমি থেকে মুক্তি।
তাই দিনের শেষে এখানে ফিরে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি। সেটাই পরম প্রাপ্তি।
লেখক বিশিষ্ট চিকিৎসক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy