সম্পদ: সারা জীবনের সংগ্রহের মধ্যে সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
ঘর-ভর্তি পুরনো রেডিয়ো, সাউন্ড প্রোজেক্টর, সাবেক ভিডিয়ো রিলের ভিড়। সেই সঙ্গে মিহি-কড়া স্বরে বেজে ওঠা অজস্র রেকর্ড, কিছু পুরনো বাদ্যযন্ত্র। অতীতের দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগের একটা আস্ত শব্দ-সূত্র আগলেই এত দিন বসে ছিলেন তিনি।
শ্যামবাজার এলাকার একটি খুদে গলির বাসিন্দা সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে নকুবাবু নিজেই সব কিছুর দেখাশোনা করতেন। ঝেড়েপুঁছে রাখতে ভালবাসতেন তাঁর শব্দবাগান। বুধবার রাতে তিনি মারা গিয়েছেন। উত্তর কলকাতার অপরিসর গলিতে ৯৪ বছরের এই দীর্ঘ জীবনের শেষে কিছু প্রশ্ন উঠে আসছে। শহরের এই বিশিষ্ট অতীত সংগ্রাহকের সারা জীবনের সম্পদের কী ভবিতব্য হতে চলেছে?
বছর দুয়েক আগে খন্না সিনেমার পিছনে শ্যামচাঁদ মিত্র লেনের ঘরটায় হাজির হয়ে তাজ্জব বনে যান ঐতিহ্য রক্ষার মঞ্চ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ট্রাস্ট ফর আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজের (ইনট্যাক) সদস্যেরা। আদি যুগ থেকে এখনও পর্যন্ত রেডিয়োর শরীরের যাবতীয় ভাল্ভ রয়েছে ওই ঘর জুড়ে। ১৯২৬ সালের জনস্টন রেডিয়োর সঙ্গী মার্কনি ফোনের লাউডস্পিকার জনৈক কাবাড়িওয়ালার থেকে জলের দরে ১২ টাকায় পেয়েছিলেন নকুবাবু। উনিশ শতকের ডোয়ার্কিনের ছাপ মারা বাদ্যযন্ত্র, পিয়ানো বাজানোর সময়ে বিট ঠিক করার মেট্রোনোমও মজুত। রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে ব্রিটিশ মিলিটারির ‘মেসেজ রিসিভার’ও। সেকেলে ব্রিটিশ গোয়েন্দা-কাহিনির সিনেমায় যেমন দেখা যায়, অপরাধীদের চলাফেরার গোপন ছবি তুলে খুঁটিয়ে দেখার বিলিতি ভিডিয়ো রিল ২২০০ টাকায় চেনা এক জনের থেকে কিনেছিলেন তিনি। ঘরে রয়েছে ৩০০০ রেকর্ডে দুষ্প্রাপ্য গান ছাড়াও চার্চিল, হিটলার, রুজভেল্ট, সুভাষচন্দ্র থেকে রাইচাঁদ বড়ালের কণ্ঠস্বর। নকুবাবু বলতেন, ‘‘আমি ওদের দয়া করে তুলে আনিনি। ওরাই আমার ভালবাসার টানে এয়েছে, আমায় ধন্য করেছে।’’
কৈশোরে খেলাচ্ছলে টুকরোটাকরা যন্ত্র জোগাড় করে ঘরেই ইলেকট্রোগ্রাম চালু করতেন তিনি। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিধিনিষেধ উড়িয়ে রেডিয়োর অ্যান্টেনায় ভাল্ভ বসিয়ে নানা কসরতে নেতাজির কণ্ঠস্বর শুনতেন শ্যামবাজারের তরুণ। বিএসসি পাশ করেও জীবনভর সিনেমা হলে অ্যামপ্লিফায়ার বসানো থেকে শব্দপ্রযুক্তি নিয়েই মেতেছিলেন। প্রবীণ বয়সেও মেতে থাকতেন সাবেক যুগের শব্দেই। একেলে ডিজিটাল শব্দে তাঁর মন ভরত না একটুও।
নকুবাবুর বড় ছেলে গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘এ সব শব্দের সরঞ্জামই বাবার প্রাণ ছিল। যতটুকু পারব, রক্ষা করব।’’ কিন্তু প্রায় আস্ত জাদুঘরের মতো এই সম্পদ একা একটি পরিবারই বা কী ভাবে সামলাবে? ইনট্যাকের আহ্বায়ক জি এম কপূরের কথায়, ‘‘গুরুসদয় দত্তের বাড়ির সংগ্রহ নিয়ে শহরে মিউজিয়াম রয়েছে। নকুবাবুর পরিজনেরা চাইলে আমরা সাহায়্য করতে পারি।’’
হেরিটেজ-স্থপতি তথা হেরিটেজ কমিশনের সদস্য পার্থরঞ্জন দাশ বলছেন, ‘‘ব্যক্তির সংগ্রহ বা নানা প্রাচীন সাংস্কৃতিক পরম্পরাকেও ঐতিহ্যের মর্যাদা দিতে আমরা সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছি।’’ বাবার সংগ্রহের পরিচর্যায় সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য স্বাগত জানাচ্ছেন নকুবাবুর পুত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy