ধ্বংসস্তূপ থেকে হাসপাতালের পথে। প্রদীপ আদকের তোলা ছবি।
রাত পেরিয়ে সকাল, তার পরে দুপুরও হয়ে গিয়েছে, উড়ালপুলে ঢালাইয়ের কাজ তখনও চলছে। কাজ করছেন জনা ৩০ শ্রমিক। তদারকি করছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা।
প্রশ্ন উঠেছে, দিনের বেলা চূড়ান্ত ব্যস্ততার সময়ে জনবহুল ওই এলাকায় এ ধরনের নির্মাণ কাজ চালানোর জন্য উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা কি আদৌ নেওয়া হয়েছিল?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বৃহস্পতিবার দুপুরে বিবেকানন্দ রোডে উড়ালপুলের নীচে রাস্তার ধারে কেবল সেই অংশটুকুই দড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল, যেখানে শ্রমিকরা ছিলেন। বাকি রাস্তায় হুস হুস করে গাড়ি ছুটছে। নির্মীয়মাণ উড়ালপুলের নীচে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন শয়ে শয়ে পথচারী। চলছে রিকশা, ট্যাক্সিও।
পূর্ত দফতরের অফিসারদের একাংশ জানিয়েছেন, সাধারণত যে সব এলাকায় এ ধরনের বড়সড় নির্মাণ কাজ চলে, সেখানে যানবাহন চলাচল করার কথাই নয়। কোনও কারণে যান নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না-হলে শুধুমাত্র রাতে রাস্তার একটি দিক বন্ধ রেখে কাজ হতে পারে। তা হলে কোন যুক্তিতে বৃহস্পতিবার যান চলাচল স্বাভাবিক রেখে ওই রকম একটা ব্যস্ত এলাকায় দিনে-দুপুরে কাজ হচ্ছিল?
এই প্রশ্নের জবাব যাঁদের দেওয়ার কথা, সেই কলকাতা পুলিশের কর্তাদের মুখে কুলুপ। তবে কেএমডিএ-র এক কর্তা জানিয়েছেন, ওপরতলার নির্দেশ ছিল— স্বাভাবিক জনজীবন কোনও রকম ভাবে ব্যাহত না করেই উড়ালপুলের কাজ করতে হবে। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের অবশ্য দাবি, ‘‘রাতে চার ঘণ্টা করে উড়ালপুলের কাজ করতে বলা হয়েছিল। কাজ সে ভাবেই চলছিল।’’
মন্ত্রীর এই দাবির সঙ্গে বাস্তবের যে কোনও মিল নেই, দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট, রবীন্দ্র সরণির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাতেই তা পরিষ্কার হয়েছে। দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের একটি ক্লাবের সদস্যরা জানান, সকালেও তাঁরা দেখেছেন ঢালাইয়ের কাজ চলছে। ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী এবং ওই এলাকায় ফল বিক্রেতা সাগর সোনকার বলেন, ‘‘সকালেও কাজ হয়েছে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ শুনি প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ। দেখি, রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে উড়ালপুলের একটি অংশ।’’ এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উড়ালপুলের যেখানে কাজ চলছিল, তার চার দিকে মাত্র কয়েক মিটার জায়গা দড়ি দিয়ে ঘেরা ছিল। কোথাও কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছিল না। উড়ালপুলের নীচে দিয়ে দিব্যি যানবাহন চলছিল।
এলাকার বাসিন্দা মধু শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘কেন জনবহুল ওই এলাকা এতটা অরক্ষিত রেখে কাজ করতে দেওয়া হল, তা নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম। ভাবছিলাম, উড়ালপুল থেকে কোনও চাঙড় নীচে পড়লে কী হবে!’’ কিন্তু শ্রীবাস্তব স্বপ্নেও ভাবেননি আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে যাবে। তাঁর দাবি— রাস্তা পুরো বন্ধ করে কাজ হলে কিংবা রাতেই কাজ শেষ করে ফেললে এত মানুষের মৃত্যু হত না।
প্রশাসন সূত্রের খবর, ওই এলাকায় পুলিশ ছিল অন্য দিনের মতোই। যান চলাচল সামলানোর জন্য ছিলেন দু’জন ট্রাফিক কনস্টেবল, এক জন সার্জেন্ট। এ ছাড়া, ঘটনাস্থলে পোস্তা থানার একটি কিয়স্ক রয়েছে। সেখানে ছিলেন দুই পুলিশ কর্মী। পুলিশের দাবি, এ দিনের ঘটনায় ওই দুই পুলিশকর্মীই মারা গিয়েছেন।
নির্মাণকারী সংস্থার তরফেও জানানো হয়েছে, ঘটনার সময়ে উড়ালপুলে নির্মাণ কাজ চলছিল। অন্তত ৩০-৪০ জন শ্রমিক সেখানে ছিলেন। নির্মাণকারী সংস্থার এক কর্তা বলেন, ‘‘আমাদের দু’জন ইঞ্জিনিয়ার নিঁখোজ। শ্রমিকদের অনেকের খোঁজ নেই।’’ কিন্তু দিনের বেলা এমন অরক্ষিত ভাবে কাজ হচ্ছিল কেন? নির্মাণকারী সংস্থার বক্তব্য, ‘‘কেএমডিএ-র তদারককারী কর্তারাই সেটা বলতে পারবেন। আমরা কেবল কাজটা করেছি।’’
অতীতে একাধিক উড়ালপুলের নির্মাণের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা কেএম়ডিএ র প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়াররা মনে করেন, নিরাপত্তা, নজরদারি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিক থেকে আরও সতর্ক হলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারত। কেএমডিএ-র কাজে এত বড় দুর্ঘটনা হতে পারে, বিশ্বাস করতে পারছেন না আর এক প্রাক্তন ডিজি সুবোধ ভট্টাচার্য। তার প্রশ্ন— কেন ঢালাইয়ের সময় বা তার পরে উড়ালপুলের নীচেটা ঘিরে রাখা হল না? ১৯৭১ থেকে তিন দশক ধরে মহানগরীর প্রায় ১৪টি উড়ালপুল নির্মাণের তদারকির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুবোধবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘প্রবল ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করাতে হয়েছিল পার্কসার্কাস উড়ালপুল। উদ্বোধনের সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু আমাকে বাহবা জানিয়েছিলেন।’’
কেএমডিএ-র প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়াররা জানান, যখন সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টরে কিংবা উল্টোডাঙায় উড়ালপুল তৈরি হয়েছে তখন যাতে নীচে দিয়ে কেউ যাতায়াত না করেন নির্মাণস্থলের আশপাশ পুরোটা ঘিরে রাখা হতো।
উল্টোডাঙা ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলার সময় এক দিন ক্রেন ছিঁড়ে সন্ধ্যায় একটি গার্ডার পড়ে যায়। তাতে একটি বাড়ির ক্ষতি হয়। তার পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন কেএমডিএ এর ইঞ্জিনিয়াররা। সিদ্ধান্ত হয় গার্ডার বসানোর সময়ে আশপাশের এলাকার বাড়ির লোকজনকে ঘরের বাইরে বার করে দেওয়া হবে। তার পর থেকে লোকজনকে নিরাপদ দূরত্বে
দাঁড় করিয়ে রেখে গার্ডার বসানো হতো। পুলিশ সূত্রের অবশ্য বক্তব্য, উড়ালপুলে এ ধরনের ঢালাইয়ের সময় নীচের রাস্তা বন্ধ করা হয় না। মাস তিনেক আগে ওই এলাকায় যখন গার্ডার বসানোর কাজ হয়েছিল, তখনই কেবল রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছিল।
নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তবু দাবি করেই চলেছেন, ‘‘দিনের বেলা কোনও কাজ করা হয়নি। ঢালাইয়ের কাজ হয়েছিল রাতে। দিনের বেলা কর্মীরা সেখানে জল দিচ্ছিলেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy