Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ধোঁয়ায় আতঙ্ক মেট্রোয়, হুড়োহুড়িতে জখম ১০

একে ঈদের বাজার, তার উপরে রেলের পরীক্ষা। সব মিলিয়ে রবিবারেও ভিড়ে ঠাসা মেট্রো। বিকেলে তেমনই একটি ট্রেন ঢুকেছিল চাঁদনি চকে। স্টেশন ছাড়ার আগে দরজা বন্ধ হতেই বিকট একটা শব্দ। গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে ভরে গেল চালকের ঠিক পিছনের কামরা, প্ল্যাটফর্মের একাংশ! নিভে গেল কামরার আলো। লাইনের পাশ থেকে কারও কারও চোখে পড়ল আগুনের ফুলকিও!

বিপর্যয়ের পরে। রবিবার, চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে। ছবি: সুমন বল্লভ।

বিপর্যয়ের পরে। রবিবার, চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে। ছবি: সুমন বল্লভ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০২:৩৩
Share: Save:

একে ঈদের বাজার, তার উপরে রেলের পরীক্ষা। সব মিলিয়ে রবিবারেও ভিড়ে ঠাসা মেট্রো। বিকেলে তেমনই একটি ট্রেন ঢুকেছিল চাঁদনি চকে। স্টেশন ছাড়ার আগে দরজা বন্ধ হতেই বিকট একটা শব্দ। গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে ভরে গেল চালকের ঠিক পিছনের কামরা, প্ল্যাটফর্মের একাংশ! নিভে গেল কামরার আলো। লাইনের পাশ থেকে কারও কারও চোখে পড়ল আগুনের ফুলকিও!

আগুন-ধোঁয়া দেখে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিলেন যাত্রীরা। কামরার দরজা ফের খুলতেই পড়িমড়ি সিঁড়ির দিকে ছুট। অনেকেরই চটি-খাবারের বাক্স ছিঁড়ে পড়ে রইল প্ল্যাটফর্মে, হারাল মোবাইল, গয়না। রবিবার বিকেলের এই ঘটনায় আহত অন্তত দশ জন। অভিযোগ, এমন হুলস্থূল কাণ্ডের সময় কোনও রেলরক্ষী-পুলিশের দেখা মেলেনি।

নিত্যযাত্রীরা বলছেন, এ শহরের মেট্রো পরিষেবা তলানিতে ঠেকেছে। বিভ্রাট হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যদিনের ঘটনা। গত দু’মাসে চার-চার বার বিভ্রাট হয়েছে মেট্রোয়। মাসখানেক আগে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জেরে পার্ক স্ট্রিট স্টেশনের সুড়ঙ্গে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল মেট্রো। তার পর ফের এ দিনের ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে মেট্রোয় উঠতে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন যাত্রীরা। যদিও কর্তৃপক্ষ এ সব মানতে নারাজ। উল্টে এ দিনের ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না তাঁরা।

মেট্রোর মুখপাত্র রবি মহাপাত্র বলছেন, বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে চাঁদনি চক স্টেশনে দমদমমুখী একটি ট্রেনে শব্দ শোনা যায়। তাতেই যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি করেন। প্রাথমিক ভাবে কর্মীরাই ফের ট্রেনটি চালু করেন। ৫টা ৫০ মিনিটে সেটি ফের দমদমের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু কী কারণে এই শব্দ, তা অবশ্য সরকারি ভাবে জানাতে চাননি মেট্রোকর্তারা। তবে মেট্রোর একটি সূত্রের খবর, ব্রেকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই এই ঘটনা। তার ফলেই আগুনের ফুলকি ও ধোঁয়া বেরিয়েছিল।

এ দিন ঘটনার কয়েক মিনিট পরে চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে দেখা যায়, স্টেশনের বাইরে ভিড় করে রয়েছেন যাত্রীরা। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পথের পাশে রেলিংয়ের গেট খোলা। ভিতরে সিঁড়ির সামনে ছড়িয়ে রয়েছে জুতোর স্তূপ। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাবার, ভাঙা চশমার টুকরো, রান্নার মশলা। তবে কোনও রেলরক্ষী বা পুলিশের দেখা মেলেনি।

স্টেশনের বাইরেই বসে ছিলেন কেয়া মণ্ডল ও সোমা মণ্ডল নামে দুই তরুণী। ভিড়ে ধাক্কাধাক্কিতে আহত হয়েছেন কেয়া। তিনি বলেন, “আগুন শুনেই আমি আর দিদি দৌড়তে শুরু করি। সিঁড়ির কাছে ভিড়ের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যাই। আমাদের মাড়িয়েই অনেকে চলে গিয়েছেন। আমাদের উদ্ধার করার মতো কোনও পুলিশ ছিল না।”

ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন?

ঝুমুর দত্তগুপ্ত নামে এক যাত্রী জানান, তিনি মেট্রোর পিছনের দিকের কামরায় ছিলেন। আলো নিভে যাওয়ার পরেই ফের দরজা খোলে। প্ল্যাটফর্মে নামতেই তিনি দেখেন, হিন্দুস্থান বিল্ডিং-মুখী সিঁড়ির দিকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসছেন লোকজন। চিৎকার করছেন ‘আগুন, আগুন’ বলে। একসঙ্গে অত লোক সিঁড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই শুরু হয় প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি। চলমান সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে পড়ে যান কয়েক জন মহিলা। “আমার চোখের সামনেই কয়েক জন মহিলা ও বয়স্ক ব্যক্তি মাটিতে পড়ে যান। তাঁদের মাড়িয়েই উপরে উঠতে থাকে আর এক দল লোক।”বলছেন ঝুমুর।

বছর তিনেকের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে মেট্রোয় উঠছিলেন অভীক চৌধুরী। ভিড়ের ধাক্কায় কোনও রকমে সরে যান তিনি। ঘটনার আধ ঘণ্টা পরেও আতঙ্ক তাঁর চোখেমুখে। বলছিলেন, “মেট্রোর কোনও কর্মী বা রক্ষী ছিল না আশপাশে। আমার সন্তানের ক্ষতি হলে কে কৈফিয়ত দিত?” রেলরক্ষী বাহিনী-পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন খোদ মেট্রোকর্মীদেরই একাংশ। এক কর্মীর বক্তব্য, “ঘটনার পরে কোনও নিরাপত্তাকর্মীকে দেখা যায়নি।”

প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশের অভিযোগ, সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময়েই মেট্রোর কয়েক জন কর্মী স্টেশনের শাটার নামিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে। শেষে যাত্রীদের বিক্ষোভের সামনে পড়ে শাটার খুলে দেওয়া হয়। যাত্রীদের প্রশ্ন, মেট্রো-পুলিশ যদি নিরাপত্তাই না দিতে পারে, তা হলে পরিষেবা দেওয়ার অর্থ কী?

বস্তুত, এ দিন ঘটনাস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূলের সভাস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন কলকাতা পুলিশের কর্তারা। কিন্তু এত বড় ঘটনার পরেও তাঁদের কাউকে চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে দেখা যায়নি। যেমন ঔদাসীন্য দেখা গিয়েছে মেট্রোর শীর্ষকর্তাদের মধ্যেও। মেট্রোরই একাংশের অভিযোগ, যাত্রী পরিষেবা ও নিরাপত্তা নিয়ে এই গড়িমসির কারণেই দিনের পর দিন বেহাল দশা হচ্ছে মেট্রোর। নাগাড়ে বিভ্রাটের পরেও কোনও ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, দিন কয়েক আগেই দিল্লিতে দরজা খোলা অবস্থায় মেট্রো চালানোর জন্য দুই কর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কিন্ত পার্ক স্ট্রিটে সুড়ঙ্গে মেট্রো আটকে যাওয়ার ঘটনায় সাসপেন্ড করা তো দূর অস্ত, এখনও তদন্তই শেষ করতে পারেননি এ শহরের মেট্রোকর্তারা।

এ দিনের ঘটনার পরেও মেট্রোকর্তাদের মধ্যে একই অভিব্যক্তি দেখা গিয়েছে। ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে মেট্রোর চিফ অপারেশন্স ম্যানেজার (মেট্রো চলাচল নিয়ন্ত্রণে অন্যতম শীর্ষকর্তা) বাসুদেব রায়কে ফোন করা হলে তিনি বলেন, “কন্ট্রোল থেকে জেনে নিন। আমি কিছু জানি না। এ সব খবর রাখার দায়িত্ব আমার নয়।” মেট্রো সূত্রের খবর, এ দিন ঘটনার পরেই শীর্ষ কর্তারা ফোন করে স্টেশনের অফিসারদের সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলতে নিষেধ করেন। যার প্রমাণ মিলেছে চাঁদনি চকে স্টেশন ম্যানেজারের কথাতেই। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার দুর্ভাগ্য, আমি কিছু বলতে পারব না। আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। যা বলার মুখপাত্র বলবেন।”

এই ঘটনার রেশ মিটতে না মিটতেই ফের ব্যাহত হয় মেট্রো পরিষেবা। এ দিন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনে বছর আঠারোর এক তরুণ দমদমমুখী একটি মেট্রোর সামনে ঝাঁপ দেন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। রাত পর্যন্ত মৃতের পরিচয় জানা যায়নি। দেহটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনার জেরে প্রায় ৪৫ মিনিট মেট্রো চলাচল ব্যাহত হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

metro problem injured 20
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE