Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সফল বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্রমোহন

‘কেশে মাখো কুন্তলীন, রুমালেতে দেলখোস, পানে খাও তাম্বুলীন, ধন্য হোক এইচ বোস।’ তাঁকে নিয়ে এমন একটা ছড়া সে কালে লোকের মুখে মুখে শোনা যেত। বিংশ শতাব্দীর কৃতী বাঙালিদের মধ্যে কারিগরি কল্পনা ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের জন্য তিনি আজও স্মরণীয়। তবু তাঁর কর্ম কৃতিত্ব বাঙালির স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে। পুরো নাম হেমেন্দ্রমোহন বসু। ছোট থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানের প্রতি। সেই সময় বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার তাঁকে আকৃষ্ট করত। সেই আকর্ষণই তাঁকে করে তুলেছিল বাংলার অন্যতম উদ্যোগপতি। তাঁর মামা জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে নানা কর্মকাণ্ডে উৎসাহ যোগাতেন।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

‘কেশে মাখো কুন্তলীন, রুমালেতে দেলখোস, পানে খাও তাম্বুলীন, ধন্য হোক এইচ বোস।’ তাঁকে নিয়ে এমন একটা ছড়া সে কালে লোকের মুখে মুখে শোনা যেত।

বিংশ শতাব্দীর কৃতী বাঙালিদের মধ্যে কারিগরি কল্পনা ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের জন্য তিনি আজও স্মরণীয়। তবু তাঁর কর্ম কৃতিত্ব বাঙালির স্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছে।

পুরো নাম হেমেন্দ্রমোহন বসু। ছোট থেকেই তাঁর আগ্রহ ছিল বিজ্ঞানের প্রতি। সেই সময় বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার তাঁকে আকৃষ্ট করত। সেই আকর্ষণই তাঁকে করে তুলেছিল বাংলার অন্যতম উদ্যোগপতি। তাঁর মামা জগদীশচন্দ্র বসু তাঁকে নানা কর্মকাণ্ডে উৎসাহ যোগাতেন।

হেমেন্দ্রমোহনের জন্ম ১৮৬৪ সালে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। মেধাবী ছাত্র হেমেন্দ্র কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু, সেখানে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে গিয়ে একটি দুর্ঘটনায় তাঁর চোখে অ্যাসিড ঢুকে যায়। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেও ছাত্রজীবনে যবনিকা নামে। পরে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বোন মৃণালিনীর সঙ্গে বিবাহ হয় হেমেন্দ্রমোহনের।

ছোটবেলা থেকেই রসায়ন তাঁকে আকৃষ্ট করত। ইতিমধ্যেই গন্ধদ্রব্য নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে ১৮৯০ সাল নাগাদ নিজের তৈরি ‘কুন্তলীন’ কেশ-তেল নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি, ১৮৯৪-এ হেমেন্দ্রমোহন ‘দেলখোস’ নামে সুগন্ধীর ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আর ছিল ‘তাম্বুলীন’। সেটা হল পান সুবাসিত এবং সুস্বাদু করার সামগ্রী। দীর্ঘ দিন পর্যন্ত এই কুন্তলীন তেল বাজারে খুব জনপ্রিয় ছিল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সেই সময় এ সবের ভাল চাহিদা ছিল মাদ্রাজ, চিন, জাপান, বর্মা, সিয়ান, জাভা এবং আমেরিকায়।

তবে, শুধু সুগন্ধীর ব্যবসায় তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি। ছাপাখানা, রেকর্ড ব্যবসা, সাইকেল, মোটরগাড়ি, ফটোগ্রাফি, সিনেম্যাটোগ্রাফি ইত্যাদির ব্যবসাও করেছেন। ১৯০০ সাল নাগাদ তিনি একটি টু-সিটার মোটরগাড়ি কিনেছিলেন। সেই সঙ্গেই শুরু করেছিলেন ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর কোম্পানি’ এবং গাড়ির যন্ত্রপাতি সারানোর জন্য ‘গ্রেট ইস্টার্ন মোটর্স ওয়ার্কস’। ১৯০৩-এ হেমেন্দ্রমোহন তাঁর ভাই জ্যোতিন্দ্রমোহন বসুর সঙ্গে শুরু করলেন সাইকেলের ব্যবসা। সেই ‘এইচ বোস অ্যান্ড কোং— সাইকেলস্’ ছিল দেশের প্রথম কোনও ভারতীয় মালিকানাধীন কোম্পানি। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন ভারতে রোভার সাইকেলস্-এর পরিবেশক। সেই সময় ক্যামেরায় শুধু সাদাকালো ছবির প্রচলন ছিল। হেমেন্দ্রমোহন অটোক্রোম লুমিয়ের স্লাইড ব্যবহার করে রঙিন ছবির প্রচলন করেছিলেন। হেমেন্দ্রমোহনের আগ্রহ ছিল নানা ধরনের খেলায়। তিনি কলকাতায় স্পোর্টস ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি ছিলেন।

১৯০০ সাল নাগাদ হেমেন্দ্রমোহন আরও দু’টি উল্লেখযোগ্য ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এই দু’টি ব্যবসাই বাঙালির বাণিজ্যের ইতিহাসে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। প্রথমটি প্রকাশনা ও ছাপাখানা এবং দ্বিতীয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— বাঙালির রেকর্ড ব্যবসা।

হেমেন্দ্রমোহন শুরু করেছিলেন কুন্তলীন প্রেস নামক এক প্রকাশনা ও ছাপাখানা। পরবর্তী কালে শুরু হয় কুন্তলীন পুরস্কার। তার ইতিহাস বাঙালির কাছে আজও স্মরণীয়। তবে নানা ব্যবসা ও উদ্যোগের মাঝে হেমেন্দ্রমোহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সিলিন্ডার রেকর্ডের ব্যবসা।

হেমেন্দ্রমোহনের তোলা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি জনসভার ছবি।

টমাস আলভা এডিসন ফোনোগ্রাফ যন্ত্রটি আবিষ্কার করার পরেই কণ্ঠস্বর বা গান ধরে রাখার প্রয়াস শুরু হয় আমেরিকা এবং ইউরোপে। নানা দেশে এ নিয়ে শুরু হয় বাণিজ্য। ১৯০০ সাল নাগাদ হেমেন্দ্রমোহন বসু একটি ‘এডিসন ফোনোগ্রাফ’ আনিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু বন্ধু এবং সে কালের বিখ্যাত কিছু শিল্পীর গান মোমের সিলিন্ডার রেকর্ডবন্দি করেছিলেন। হেমেন্দ্রমোহনের সেই সব বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন তাঁর মামা জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ। সাউন্ড রেকর্ডিং-এর প্রতি হেমেন্দ্রমোহনের আগ্রহ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল ফোনোগ্রাফ ও সিলিন্ডার রেকর্ডের ব্যবসায় আসতে।

১৯০৪ সাল নাগাদ ফ্রান্সের প্যাথেফোন কোম্পানির সঙ্গে হেমেন্দ্রমোহনের বাণিজ্যিক যোগাযোগ হয়। ৪১ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রিটের, মার্বল হাউসে শুরু হয় সিলিন্ডার রেকর্ড ও ফোনোগ্রাফের ব্যবসা। সেই দোকানের নাম ছিল ‘টকিং মেশিন হল’। ১৯০৬ নাগাদ হেমেন্দ্রমোহন শুরু করেছিলেন তাঁর নিজস্ব রেকর্ডের প্রতিষ্ঠান ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’। তৎকালীন সংবাদপত্রে ‘এইচ বোসেস রেকর্ড’-এর পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেখা যেত। আর শিল্পী তালিকায় চোখে পড়ত স্টার থিয়েটারের নরীসুন্দরী, বসন্তকুমারী কিংবা কাশীবাবুকে। শুরুর দিকে, শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তেমনই ধ্রুপদী সঙ্গীতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন কিংবদন্তি উস্তাদ রমজান খান, মেটিয়াবুরুজের পিয়ারা সাহেব ও লালচাঁদ বড়াল। অল্প সময়ের মধ্যেই বোসেস রেকর্ডস-এর জনপ্রিয়তা বাজারে ছেয়ে গিয়েছিল।

পরবর্তী কালে বাজারে ডিস্ক রেকর্ড আসায় সিলিন্ডার রেকর্ডের চাহিদা কমতে থাকে। হেমেন্দ্রমোহন প্যাথে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে সিলিন্ডার রেকর্ডের গানগুলি ডিস্ক রেকর্ডে প্রকাশ করতে থাকেন। এই সব রেকর্ডগুলি বেলজিয়াম থেকে ছেপে আসত। তাতে লেখা থাকত ‘প্যাথে এইচ বোসেস রেকর্ড’।

হেমেন্দ্রমোহনের রেকর্ডের বিজ্ঞাপন।

১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী অন্দোলনে গোটা দেশ তখন উত্তাল। হেমেন্দ্রমোহন ইতিমধ্যেই স্বদেশি রেকর্ড ব্যবহারের ডাক দিয়ে দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গাওয়া দেশাত্মবোধক গান ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল হেমেন্দ্রমোহনের মোমের তৈরি সিলিন্ডার রেকর্ড। সিলিন্ডার রেকর্ডেই রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড করেছিলেন যদুভট্টের সুরে বন্দেমাতরম। একই গান রেকর্ড করেছিল সেবক সম্প্রদায়। সেই সময় স্বদেশি গানের উপর ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯০৮-এর ৯ ডিসেম্বর তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ অভিযান চালায় হেমেন্দ্রমোহনের অফিস ও কারখানায়। বাজেয়াপ্ত করা হয় প্রচুর মোমের রেকর্ড ও ব্যবসার নথিপত্র। নষ্ট করে ফেলা হয় সেগুলি। হারিয়ে যায় বাঙালির রেকর্ড ব্যবসা ও সঙ্গীতের দুর্মূল্য প্রমাণ। তবু বন্ধ হয়নি বোসেস রেকর্ডস।

ছবি সৌজন্য: এএন শর্মা।

শেষপর্যন্ত ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্যাথে কোম্পানি নানা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় ভারতে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হেমেন্দ্রমোহন সে কথা জানতেন না। ইতিমধ্যেই তিনি বেশ কিছু মোমের সিলিন্ডার ফ্রান্সে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ডিস্ক হিসেবে প্রকাশ করার জন্য। তাঁর মধ্যে ছিল রবীন্দ্রনাথের গাওয়া বেশ কিছু গান। সে সব রেকর্ড আর কোনও দিনও দেশে ফেরেনি। হারিয়ে গিয়েছিল বাঙালির সঙ্গীতচর্চার অজানা এক অধ্যায়। এর পরে হেমেন্দ্রমোহনও রেকর্ড ব্যবসা থেকে অন্য ব্যবসায় মন দিয়েছিলেন।

১৯১৬-র ২৮ অগস্ট হেমেন্দ্রমোহনের মৃত্যু হয়। তবে মুছে যায়নি তাঁর কর্মকৃতিত্ব। আজও বিভিন্ন পুরনো জিনিসের সংগ্রাহকদের কাছে এইচ বোসের সিলিন্ডার রেকর্ড থেকে কুন্তলীনের শিশি বা বেলজিয়াম থেকে ১০০ বছর আগে ছেপে আসা ‘প্যাথে এইচ বোসেস রেকর্ড’ দুর্মূল্য কালেক্টর্স আইটেম রয়েছে। যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে ঘুরতে ঘুরতে টানর্টেবলের ১০০ আরপিএম স্পিডে আজও যখন বেজে ওঠে রবিবাবুর গাওয়া ‘বন্দেমাতরম’ তখন স্মৃতির অতল থেকে উঁকি দেয় এইচ বোসের সেই অভূতপূর্ব প্রয়াসের ঝলকানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE