Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
তৃতীয় নয়ন
general-election-2019-west-bengal

রাষ্ট্র তার শোওয়ার ঘরে আয়না রাখে না

খবর পৌঁছল রাজার কানে, তিনি পাঠালেন পেয়াদা। গেস্টাপোর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক সটান ‘পিকাসো’র প্যারিসের বাড়িতে পৌঁছলেন, দেওয়ালে তখন টাঙানো ‘গেরনিকা’-র প্রতিলিপি।

শ্রীজাত
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৩৬
Share: Save:

তা হলে শুরু করা যাক ‘গেরনিকা’ সংক্রান্ত সেই বিখ্যাত গল্প দিয়েই। গল্প নয় যদিও, সত্যি। তবে কিনা এ আমলে সত্যিকেই গল্প বলে মনে হতে থাকে। স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন বোমাবর্ষণে স্প্যানিশ শহর গেরনিকা-কে ধূলিসাৎ করে দেয় জার্মানির নাৎসি বাহিনী ও ইতালির ফাসিস্ত সেনা। সেটা ১৯৩৭ সাল, পিকাসো তাঁর দেওয়াল জোড়া ক্যানভাস নিয়ে আঁকলেন নতুন এক ছবি। নাম দিলেন ‘গেরনিকা’। তাঁর সে-যাবত ছবিতে ভাঙচুর আর নিরীক্ষা তো নতুন কিছুই নয়, কিন্তু ‘গেরনিকা’-এ নগ্নভাবে ধরা দিল যুদ্ধের বীভৎসতা, যার সামনে মানুষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আত্মগ্লানিতে মাথা নেমে আসতে বাধ্য।

খবর পৌঁছল রাজার কানে, তিনি পাঠালেন পেয়াদা। গেস্টাপোর এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক সটান ‘পিকাসো’র প্যারিসের বাড়িতে পৌঁছলেন, দেওয়ালে তখন টাঙানো ‘গেরনিকা’-র প্রতিলিপি। সেই ছবিকে উদ্দেশ করে আধিকারিক পিকাসোকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ কাজ আপনি করেছেন?’ জবাবে টানটান পিকাসো’র নিঃস্পৃহ উত্তর ছিল, ‘আমি নই, আপনারা করেছেন’। কথা খুব স্পষ্ট। রাষ্ট্র যা করছে, যা করে চলেছে, এ ছবি তারই নির্ভীক প্রতিফলন। নইলে এমন একখানা ভয়াবহতার দৃশ্যপট আঁকবার প্রয়োজনীয়তাই আসত না হয়তো। সুতরাং, ‘গেরনিকা’ আদতে প্রতিফলন হয়েও, প্রতিবাদ। আসলে তা আয়না, লজ্জাবাহক আরশি। যা পিকাসো উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রের কোমল হাতে।

বহু বছর পরে এই একই বাক্য নিঃসৃত হল আর এক শিল্পীর মুখ থেকে, সাদাত হাসান মান্টো বললেন, ‘যদি তুমি আমার গল্পদের সহ্য করতে না পারো, তা হলে জানবে এই সমাজটাই অসহ্য’। এ জিনিস ঘটে এসেছে বারবার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বীভৎসতার মুখের সামনে আয়না তুলে ধরবার পরিণতি তাহলে কী? পিকাসো’র মতো শিল্পীকে পড়তে হয়েছিল জেরার মুখে, আর মান্টোর কী হয়েছিল তাও আমাদের অজানা নয়। রাষ্ট্র কোনও প্রশ্ন পছন্দ করে না। সে কেবল দাবি করে অনুগমন, অনুসরণ। অনুসন্ধান তার অভিধান থেকে বাদ। যদি কেউ কারণ খুঁজতে বেরোও, যদি কেউ আঙুল তোলো কোনও অপছন্দের ঘটনার দিকে, যদি কেউ জানতে চাও এর আসল কারণটা ঠিক কী? তা হলে সেই চোখ, সেই গলা, সেই আঙুল নিশ্চিহ্ন করে ফেলাই হল রাষ্ট্রের ধর্ম। মহাভারত বা ওডেসি থেকে তা-ই চলে আসছে, ২০১৯-এ তা বদলে যাবে, এমন আশা করার বয়স আর আমার নেই। রাষ্ট্র মাথা কিনতে বেরোয় বিকেলবেলা। আয়না তার দু’চোখের বিষ।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নির্বাচনের প্রহর এলেই আমার ছোটবেলার নির্বাচন মনে পড়ে যায়। অশান্তির খবর কি ছিল না? তখন টেলিভিশনে এতগুলো চ্যানেল নেই, ইন্টারনেট নামক বস্তুটিই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই নাগালের বাইরে ঠিক কী কী ঘটে চলেছে, তার ঠিকঠাক হদিস পাওয়া ছিল দুষ্কর। তবু বুঝতাম, দখল হচ্ছে, মারধর চলছে, চাপানউতোর জারি। তবে সেটা কোন পর্যায়ে, এই হচ্ছে প্রশ্ন। কিন্তু মনে পড়ে না, প্রত্যেক দিন ধর্মীয় জঙ্গিপনার খবর পড়েছি বলে। বা মনে পড়ে না, প্রতি মুহূর্তে কার কোন ধর্ম এ নিয়ে কেউ সচেতন থেকেছি। এ-ও মনে পড়ে না, মানুষকে সারা দেশ জুড়ে ধর্মের চকখড়ি দিয়ে দাগানো হচ্ছে, আর সেই দাগিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া নেহাত নিরীহও নয়। মনে পড়ে না। কিন্তু এখন, আজ, চোখে পড়ে। এবং চোখে লাগে, বিঁধে যায় কাচের টুকরো হয়ে।

ঠিক কোন সময় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণ আমাদের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল যে তা নিয়ে রোজ কোথাও না কোথাও কোনও ধিক্কারযোগ্য ঘটনা ঘটে চলেছে? ঠিক কোন সময় থেকে আমার ভক্তি আমি চাপিয়ে দিতে শুরু করলাম পাশের বাড়ির লোকজনের উপর? ঠিক কোন সময় থেকে ডাল-ভাতের চেয়ে, রুটি-রুজির চেয়ে, গান-কবিতার চেয়ে, শ্রম-অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠল মানুষের ধর্মীয় পরিচয়? আর ধর্মের জিগির তুলে একে অপরকে প্রশ্ন করার, এমনকি পিটিয়ে মেরে ফেলবার অধিকার পেয়ে গেলাম আমরা? ঠিক কোন সময় থেকে? এ প্রশ্ন তোলা যাবে না। তোলা যাবে না জাতের প্রশ্নও। ঠিক কোন বিবেক আমাকে নির্দেশ দেয় সেই ‘দলিত’কে মেরে ফেলতে, যে ‘উঁচু’ জাতের উৎসব পালনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল, আমি জানি না। ঠিক কোন আইন আমাকে মান্যতা দেয় কেবল ‘অচ্ছুত’ বলে বর-বৌ-ছেলের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলে তাদের নগ্ন করে ঘোরাতে, আমি জানি না। পোশাক কি রিমোটে খোলা যায়? তখন স্পর্শ করতে হয় না তাদের? কে জানে। প্রশ্ন করা যাবে না।

অবশ্য আমার মতো হদ্দ বোকা কেউ কেউ মাঝেমধ্যে নেহাতই কৌতূহল চাপতে না পেরে করে ফেলে দু’একখানা প্রশ্ন। আর তার পরিণতি কী হয়, আমি অন্তত জানি। গত দু’বছরের প্রতি মুহূর্ত ব্যয় করে আমাকে বুঝে নিতে হয়েছে, প্রশ্ন তোলার মাসুল হিসেবে কী কী হতে পারে। বুঝিয়েও দেওয়া হয়েছে, শৈল্পিক তর্কের কোনও জায়গা নেই কোথাও। এক জন নাগরিকের তোলা প্রশ্নকে তাই সম্মুখীন হতেই হবে আক্রমণের, হামলার, মারের। যাতে প্রশ্ন আর কোনও ভাবে উঠে না আসে কখনও। কিন্তু যাঁরা এই পদ্ধতিতে বিশ্বাসী, সুযোগ সুবিধে মতো প্রশ্ন করে দেখেছি, আমার একটি বইও তাঁরা চোখে দেখেননি। কেবল নির্দেশ পেয়েছেন, এই লোকটিকে কোথাও পেলে হামলা করতে হবে। সে-ই যথেষ্ট। তাই চুপ করে যেতে হয় অনেক সময়ে। চুপ থাকি। কিন্তু হাড়-মাংস জ্বলবার চটাপট আওয়াজের মধ্যে বসে নাক সিঁটকে গোলাপকাব্য রচনা করতে পারি না তবু। কবর খোঁড়ার অবিরাম হিম শব্দের মধ্যে বসে রচনা করতে পারি না পরকীয়া-আখ্যান। হাত থমকে যায়। বোকা, নিরুপায় হাত আমার। কেটে ফেলবার আগমুহূর্তে এক বার সে থমকায়। ভাবে, কী লিখতে চেয়েছিলাম আসলে।

সেই দেশেই ফের ভোট হচ্ছে। আমার বিশেষ কোনও অনুরাগ নেই আর, গরিমাও নেই তেমন। যদিও দায়িত্বটুকু থেকে যায়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলে চলবার। এই দেশকে অন্ধত্বের আগুন থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার একার কই? তবু, প্রলয় যে বন্ধ থাকে না, সে-কথা বলে চলবার কাজটুকু তো নিতেই হবে। তাই এই লেখা। এ-রাজ্য বলে বেঁচে আছি, সে-রাজ্য হলে মরে যেতাম, এ তো কোনও শ্লাঘার বিষয় নয়, কবিতা লেখার জেরে আশপাশে দেহরক্ষী আর বাড়ির চারধারে পুলিশি প্রহরা মোতায়েন করতে হবে, এ-ও রাষ্ট্রেরই লজ্জা। আমার সহজ, সাধারণ, স্বাভাবিক যাপন হারিয়ে যাওয়ার দায় কি রাষ্ট্র নেবে? নাহ। কেননা রাষ্ট্র তার শোওয়ার ঘরে আয়না রাখে না। হরিণের মাথা টাঙায়।

এ বারের নির্বাচনে কী হবে, জানি না। জেনে লাভই বা কী, তা-ও জানি না। কেবল আকাঙ্ক্ষা রাখতে পারি, এই ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ যেন ক্রমাগত পিছিয়ে না যায়। বহু জরুরি কাজ করবার আছে, বহু প্রয়োজনীয় সমাধানের দিকে যাওয়ার আছে, সে সব ছেড়ে আমরা যেন অশিক্ষিতের মতো বায়বীয় অস্তিত্ব নিয়ে একে অপরের উপর চড়াও না হই। মহাকাশে ঘুরন্ত লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করার গৌরবময় কৌশল আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। পাশাপাশি আমরা যেন আমাদের অন্তরে জ্বলন্ত বিভেদের চারাগাছকেও মুড়িয়ে নিতে পারি। যেন এই দেশের নাগরিক হয়ে দেশের মাটির প্রতি ইঞ্চিতে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলবার স্বাধীনতা আমার থাকে। যেন নিজেদের দুর্ভাগ্যজনক ও হাস্যকর করে তোলবার ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় নাম না লিখিয়ে মন দিতে পারি যার যার আদত কাজে। নইলে কোনও ভোটাধিকার আমাদের বাঁচাতে পারবে না। নইলে আমাদেরও পেরোতে হবে গৃহযুদ্ধের দিনকাল। নইলে আমাদের হাঁটতে হবে আরও বহু ‘গেরনিকা’-র দিকে।

সারা ছোটবেলা থেকে আজ অবধি কেটেছে গানবাজনার মধ্যে। মনে পড়ে, লোডশেডিং-এর গভীর জ্যোৎস্নারাতে কানে এসে আছড়ে পড়ত মালকঁওস-এর বন্দিশ, ‘জিন কে মন রাম বিরাজে’। গাইছেন আমির খান সাহেব। আর ভরা বর্ষার ঝমঝম মিয়াঁ কি মলহারে গর্জে উঠছে ভীমসেন জোশী’র কণ্ঠ, ‘এ করিম নাম’। ‘রাম’ এবং ‘করিম’, এই দুই শব্দের এর চাইতে শুদ্ধ উচ্চারণ আমার কানে আজও বাজেনি। আজ, এই অন্ধকার মহালগ্নে দাঁড়িয়ে আমি কেবল জানতে চাই, আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের বুকে এই দুই চরম অপরাধীর জন্য তবে কী শাস্তি ধার্য, মহামান্য ধর্মাবতার? রাত অনেক হল। উত্তর মেলে না...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE