Advertisement
E-Paper

পিংলায় সাত নাবালক-সহ ছিন্নভিন্ন বারো

খাগড়াগড়ের মতো লুকনো ডেরা নয়। সবার চোখের সামনেই চলছিল বেআইনি বাজির কারখানা। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরে পিংলার সেই কারখানায় যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেড়ে নিল ১২টি প্রাণ, তার অভিঘাতে আরও এক বার কেঁপে উঠল রাজ্য রাজনীতি। অনেকটা খাগড়াগড়ের মতোই।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৫ ০৩:৫২
পিংলায় বিস্ফোরণে ছেলেকে হারিয়ে মেদিনীপুর মেডিক্যালের মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা। বৃহস্পতিবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

পিংলায় বিস্ফোরণে ছেলেকে হারিয়ে মেদিনীপুর মেডিক্যালের মর্গের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা। বৃহস্পতিবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

খাগড়াগড়ের মতো লুকনো ডেরা নয়। সবার চোখের সামনেই চলছিল বেআইনি বাজির কারখানা। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরে পিংলার সেই কারখানায় যে ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেড়ে নিল ১২টি প্রাণ, তার অভিঘাতে আরও এক বার কেঁপে উঠল রাজ্য রাজনীতি। অনেকটা খাগড়াগড়ের মতোই।

বুধবার রাতের এই ঘটনায় খাগড়াগড়ের মতোই সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিরোধীরা চাইছেন এনআইএ তদন্ত, খাগড়াগড়ের মতোই। ফের এখানেও অভিযোগের আঙুল শাসক দলের যোগসাজশের দিকে। গ্রামবাসীদের বড় অংশেরই দাবি, পুলিশকে বারবার ওই বেআইনি বাজির কারবারের কথা জানিয়ে লাভ হয়নি। কারখানার জমির মালিক তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বলেই পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। বৃহস্পতিবার দিনভর শাসক দল এবং বিরোধীদের চাপানউতোরের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য পুলিশের উপরেই ভরসা রাখার বার্তা দিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, বুধবার রাত পৌনে দশটা নাগাদ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পিংলা থানার ব্রাহ্মণবাড় গ্রাম। পরপর বিস্ফোরণের আওয়াজ পৌঁছে যায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ডেবরা, সবংয়ের বিভিন্ন এলাকাতেও। গ্রামবাসীরা বাইরে বেরিয়ে দেখেন, বাজি কারখানাটি দাউ দাউ করে জ্বলছে। সাড়ে দশটা নাগাদ গ্রামে পুলিশ পৌঁছয়। কিছু পরে আসে দমকল। বৃহস্পতিবার ভোরের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তত ক্ষণে গোটা কারখানাই পুড়ে ছাই। মাটি রক্তে মাখামাখি। চার দিকে ছড়িয়ে ছিন্নভিন্ন দেহাংশ।

কারখানার মালিক, পিংলারই সুদছড়া গ্রামের বাসিন্দা রামপদ মাইতি (৩২), তাঁর স্ত্রী রিনা মাইতি-সহ (২৮) মোট ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে এই ঘটনায়। মৃতদের মধ্যে সাত জন নাবালক। ঝলসে যাওয়া আরও চার জনকে ভর্তি করানো হয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। তাদের মধ্যেও দু’জন নাবালক। এদের বেশির ভাগেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদের সুতিতে। বাজি কারখানায় কাজ করত তারা। সাম্প্রতিক অতীতে কোনও দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এত জন নাবালকের মৃত্যু এ রাজ্যে হয়নি। গ্রামবাসীদের অবশ্য দাবি, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি। ঘটনার পরে গ্রামে এসে পুলিশ বেশ কিছু দেহ লোপাটের চেষ্টা করে বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁরা।

গত বছর অক্টোবর মাসে বর্ধমানের খাগড়াগড় গ্রামে বোমা তৈরির গোপন ডেরায় বোমা বাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ঘটনায় দু’জনের মৃত্যু হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ওই ডেরাটি ছিল জঙ্গিদের গোপন কর্মশালা। সন্ত্রাসের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের অন্যতম কেন্দ্র। সেখান থেকে বোমা ও বিস্ফোরক পৌঁছে দেওয়া হতো বিদেশেও।

পিংলার কারখানায় বাজির পাশাপাশি বোমাও তৈরি হতো কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, ওখানে বাজির আড়ালে বোমাও তৈরি হতো। অকুস্থলে ছড়িয়ে থাকা মালমশলা দেখে পুলিশ-প্রশাসনও সে আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারেনি। আর বিরোধীদের দাবি— জঙ্গি-সন্ত্রাস নয়, পিংলায় তৈরি বোমা ব্যবহার হতো এ রাজ্যের রাজনৈতিক সন্ত্রাসে। বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং বিজেপি— তিন দলেরই অভিযোগ, পুরভোটে সন্ত্রাস চালানোর জন্যই পিংলায় রসদ মজুত করা হয়েছিল!

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, ‘‘পিংলায় যে বোমা তৈরি হতো, তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা বামপন্থী-সহ বিরোধী দলের বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করত। হঠাৎ তাতে বিস্ফোরণ হওয়াতেই এত জনের মৃত্যু হয়েছে।’’ সূর্যবাবু আজ, শুক্রবার ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন। দিল্লিতে কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শুধুমাত্র বাজি বিস্ফোরণে এত জনের মৃত্যু সম্ভব নয়। এর পিছনে খাগড়াগড়ের ছায়া আছে! বিষয়টি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এল সি গয়ালকে জানিয়েছি।’’

পিংলার কারখানায় যে বোমা তৈরি হতো, তার কোনও প্রমাণ মিলেছে কি? পুলিশ সূত্রে খবর, বম্ব স্কোয়াডের লোকেরা বাজির মশলা গুঁড়ো করার ও মশলা মেশানোর যন্ত্র বাজেয়াপ্ত করেছেন। কিন্তু তারই সঙ্গে পাওয়া গিয়েছে প্লাস্টিকের বল, স্টোনচিপ্‌স। ফলে পুলিশেরও একাংশের অনুমান, ওই প্লাস্টিকের বলে বারুদ ও স্টোনচিপ্‌স ভরে বোমা তৈরি করা হতো। স্টোনচিপ্‌‌স স্‌প্লিন্টারের কাজ করত। এ দিন সন্ধ্যায় ডিআইজি সিআইডি (অপারেশন) দিলীপ আদক এলাকা পরিদর্শনের পরে বলেন, ‘‘এখানে স্টোনচিপ্‌স জাতীয় যে স্‌প্লিন্টার পাওয়া গিয়েছে, তাতে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়, আলু বোম জাতীয় কিছু তৈরি হতো। ফরেন্সিক রিপোর্ট পেলে বিষয়টি নিশ্চিত ভাবে বোঝা যাবে।’’ রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানিয়েছেন, ওই বাড়িতে প্রাথমিক ভাবে যে সরঞ্জাম পাওয়া গিয়েছে, তাতে চাইলে দেশি বোমাও তৈরি করা যায়। ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যর অভিযোগ, ‘‘নিশ্চিত ভাবেই এখানে বোমা তৈরি হতো। এবং তা পুলিশের যোগসাজশেই হতো।’’

পুলিশ অবশ্য এখনই প্রকােশ্য বলেনি বোমা তৈরির কথা। বুধবার রাতেই ঘটনাস্থলে যান জেলার পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ-সহ জেলা পুলিশের কর্তারা। পর দিন সকালে আসেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত। পৌঁছয় বম্ব স্কোয়াড ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) বলেন, ‘‘এখন বিয়ের মরসুম। তাই ওরা বাজি বানাচ্ছিল।’’

বিয়েবাড়ির জন্য কেন এত বাজি বানানো হচ্ছিল, সেটা অবশ্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীরও প্রশ্ন। এ দিন নামখানায় একটি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সে কথা গোপনও করেননি। তিনি বলেন, ‘‘পিংলার খবরটা বুধবার রাত আড়াইটে নাগাদ শুনি। সিআইডি-কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। আমি সিভিক ভলান্টিয়ার, গ্রিন পুলিশ, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি থেকে সাধারণ মানুষ— সকলকে বলছি, আপনার এলাকায় এমন কোনও খবর পেলে কাছের থানায় জানান।’’

কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, তদন্ত সবে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশের বড় কর্তারা কী ভাবে বলে দিলেন, বিয়েবাড়ির জন্যই বাজি তৈরি হচ্ছিল? তাঁদের বরং আশঙ্কা, সিআইডি হোক বা জেলা পুলিশ— আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতে পারে। ঠিক যে অভিযোগ প্রথম দিকে উঠেছিল খাগড়াগড়ের ঘটনায়। তাই বিরোধী নেতারা পিংলাতেও এনআইএ তদন্ত চেয়ে রাজ্য সরকারের উপরে চাপ বাড়াচ্ছেন।

গোটা ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের যোগসাজশের অভিযোগ এনে গ্রামবাসীরাও সরব হচ্ছেন। কারণ, যাঁর জমিতে ওই বাজি কারখানা চলত, সেই রঞ্জন মাইতি এলাকায় সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত। এ দিন সকালে পিংলার জলচক থেকে রঞ্জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রামবাসীর বড় অংশের অভিযোগ, মৃত রামপদকে সামনে রেখে বেআইনি বাজি কারখানাটি চালাতেন রঞ্জনই। পুলিশকে একাধিক বার সে কথা জানিয়েও লাভ হয়নি। শাসক দলের লোক বলেই পুলিশ কোনও বাধা দেয়নি বলে এলাকাবাসীর দাবি।

সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও বক্তব্য, পিংলার ওসি পঙ্কজ মিস্ত্রির বিরুদ্ধে বারবার রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। তাঁর কথায়, ‘‘ওই ওসি-কে সামনে রেখেই বিনা বাধায় বেআইনি কারবার চালিয়েছে শাসক দল।’’ পুলিশেরও একটি অংশ জানিয়েছেন, গত নভেম্বরে থানার কালীপুজোতে যাবতীয় বাজি এসেছিল রামপদ-রঞ্জনের কারখানা থেকেই।

মৃত কারখানা-মালিক রামপদ আগে সুদছড়া গ্রামে তাঁদের নিজের বাড়িতে বাজি কারখানা চালাতেন। সেখানেও এক বিস্ফোরণের পরে বছর দুয়েক আগে তিনি চলে আসেন ব্রাহ্মণবাড়ে। এখানে রঞ্জনের জমিতে তাঁরা নতুন কারখানা শুরু করেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য রঞ্জনকে দলের কেউ বলে মানতে নারাজ। পিংলার বাসিন্দা তথা তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অজিত মাইতির দাবি, ‘‘রঞ্জন আগে তৃণমূল করলেও মাস আটেক হল, দলের সঙ্গে তার কোনও যোগ নেই। সম্প্রতি ও বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল।’’

এই দাবি উড়িয়ে রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ আসানসোলে বলেন, ‘‘শুনেছি, ওই কারখানা তৃণমূলের স্থানীয় নেতার।’’ দুর্গাপুরে বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ অভিযোগ করেন, ‘‘খাগড়াগড়ের ঘটনার পরে আমরা বলেছিলাম, বিদেশি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূল সন্ত্রাসবাদের তীর্থভূমি করতে চাইছে এই রাজ্যকে। এ বার পিংলাতেও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয়েছে। দু’জায়গাতেই তৃণমূল যোগ পাওয়া গিয়েছে।’’

রঞ্জনের বাড়ি থেকে দক্ষিণ ভারতের কয়েক জন বাসিন্দার পরিচয়পত্র পেয়েছে পুলিশ। সূর্যবাবুর আশঙ্কা, ‘‘এই বোমা বানানোর সঙ্গে যারা যুক্ত, তামিলনাড়ু পর্যন্ত তাদের যোগাযোগ রয়েছে। ফলে রাজ্যের কোনও তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে এই তদন্ত করা সম্ভব নয়।’’ রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে গিয়ে ইতিমধ্যেই এনআইএ তদন্ত দাবি করেছে মহম্মদ সোহরাবের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পরিষদীয় দল। অমিত শাহ ও রাজনাথ সিংহকে সব রিপোর্ট দিয়েছেন বলে জানিয়ে রাহুলবাবুরও বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি, এ বার আর যেন কাউকে এনআইএ তদন্তের জন্য অনুরোধ করতে না হয়। তিনি নিজে কেন্দ্রের কাছে আবেদন করুন।’’

রাজ্য প্রশাসন অবশ্য এখনই এনআইএ-র মতো সংস্থাকে ডাকার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করছে। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘যা কিছু হয়, তার পিছনেই বিরোধীরা তৃণমূল দেখে! তৃণমূলের সমালোচনা ছেড়ে ওঁরা রাজ্যের গঠনমূলক কাজে একটু সময় দিন!’’

macabre blast pingla blast pingla bomb factory 12 dead 7 minor dead pingla tattered body
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy