Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দশমী শেষে মিলন মেলা বেলপাহাড়িতে

মাথার উপর একাদশীর চাঁদ। দিদ্রিম দিদ্রিম মাদলের বোল উঠেছে। বাতাসে ভেসে আসছে মহুয়ার ঝিম। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তরুণ-চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে জীবনসঙ্গিনীকে! পছন্দ যদি হয়? মারাংবুরু সাক্ষী আছেন। দুই পরিবারের পাকা কথা এখানেই হয়ে যাবে। দুঃখের দশমী শেষে বেলপাহাড়ির ওড়গোন্দা ভৈরব মন্দির লাগোয়া প্রান্তরে আয়োজিত আদিবাসীদের মিলন মেলায় এই রীতি চলে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। শতাব্দী প্রাচীন এই মেলায় আয়োজন হয় একাদশী তিথিতে।

চলছে প্রার্থনা। —ফাইল চিত্র।

চলছে প্রার্থনা। —ফাইল চিত্র।

কিংশুক গুপ্ত
ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:২১
Share: Save:

মাথার উপর একাদশীর চাঁদ। দিদ্রিম দিদ্রিম মাদলের বোল উঠেছে। বাতাসে ভেসে আসছে মহুয়ার ঝিম। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে তরুণ-চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে জীবনসঙ্গিনীকে! পছন্দ যদি হয়? মারাংবুরু সাক্ষী আছেন। দুই পরিবারের পাকা কথা এখানেই হয়ে যাবে। দুঃখের দশমী শেষে বেলপাহাড়ির ওড়গোন্দা ভৈরব মন্দির লাগোয়া প্রান্তরে আয়োজিত আদিবাসীদের মিলন মেলায় এই রীতি চলে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। শতাব্দী প্রাচীন এই মেলায় আয়োজন হয় একাদশী তিথিতে। রাতভর নাচ-গান আর উৎসব। দ্বাদশী তিথিতে মেলা শেষ হয়। এবার দু’দিনের এই মেলা শেষ হল রবিবার। এ রাজ্যের পাশাপাশি, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, অসম-সহ আরও বহু এলাকা থেকে হাজার হাজার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ আসেন এই মেলায়। সাঁওতাল সংস্কৃতিতে এটাই কার্যত আদিবাসীদের কুম্ভ মেলা। স্থানীয়েরা বলেন পাটাবিঁধা মেলা। ঝাড়গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বিশিষ্ট সমাজসেবী খগেন্দ্রনাথ মাণ্ডি বলেন, “সারা দেশের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ এই মিলন মেলায় মেলায় সমবেত হন। মেলা প্রাঙ্গণে জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনী খোঁজার এই রীতি সামাজিক প্রথারই অঙ্গ।” খগেন্দ্রনাথবাবু জানান, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনও ঘটে বার্ষিক এই উৎসবে।

ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায় জানালেন, মেলার পিছনের উপাখ্যান। যে কাহিনী এক উলটপুরাণ! সাঁওতাল লোকগাঁথা অনুযায়ী, প্রাচীনকালে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমীর দিনেই ‘যদুবংশী’ বীরপুরুষ হুদুড়দুর্গাকে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেন উচ্চবর্ণের ‘দেবাংশী’ নারী দেবীদুর্গা। জনশ্রুতি, প্রাচীনকালে জঙ্গলমহলের সাঁওতালদের বলা হতো যদুবংশী। তাদের প্রবল পরাক্রমী রাজা ছিলেন হুদুড়দুর্গা। কিন্তু উচ্চবর্ণের বহিঃশত্রু ‘দেবাংশী’রা যদুবংশীদের এলাকা দখলের মতলব করেন। কিন্তু কোনও ভাবেই হুদুড়কে যুদ্ধে হারাতে না পেরে, দেবাংশীরা দৈবশক্তি একত্রিত করে এক নারী যোদ্ধাকে সৃষ্টি করেন। তিনিই দেবী দুর্গা। সেই আর্যনারী মোহিনী রূপ ধরে হুদুড়ের রাজসভায় ঢুকে তাঁকে কৌশলে হত্যা করেন। হুদুড়ের মৃত্যুর পরে যদুবংশী পুরুষদের নির্বিচারে হত্যা করেন দেবাংশীরা। যদুবংশীদের উৎখাত করে এলাকা দখল করে নেন তারা। সেই থেকে দুর্গাপুজোর চারদিন রাজা হুদুড়ের মৃত্যুতে শোকপালন করেন সাঁওতালেরা। শোকাবহ সেই ‘দাঁসায়’ পরবের শেষে দশমীর দিন গ্রামে গ্রামে শোকসভার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় পরব। ওড়গোন্দার ভৈরব মন্দির হল সাঁওতালদের দেবতা মারাংবুরুর থান। একাদশীর দিন সেখানেই শুরু হয় দু’দিনের মিলন মেলা। তবে শেষ দিনে অর্থাৎ দ্বাদশী তিথিতে এলাকাটি কার্যত সাঁওতালদের জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

সাঁওতালদের মুখে মুখে এখনও জনশ্রুতি ঘোরে ফেরে। রাঁচি থেকে আসা আশি ছুঁই ছুঁই ডগমণি মুর্মু বলেন, “বাপ ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি, এক সময় দেবাংশীদের অত্যাচারে দেশ তো শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। সমাজ বাঁচাতে পরিবার গড়ে তোলার প্রয়োজন পড়ে। সেই থেকে মেলায় নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যাতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে, সেদিকেও নজর দেওয়া হয়।” ধানবাদের রাজারাম বাস্কে, চাকুলিয়ার মুনসি হেমব্রম-দের কথায়, “মেলায় অনেকেরই পাকা দেখা হয়ে যায়। দূরে থাকা অনেক অদেখা আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। শোকের শেষে এই মিলন মেলায় এসে আমরা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করার শপথ নিই।” গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ক্ষয়িষ্ণু জনজাতি নিজেদের অস্তিত্বের সংকট থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে দেবতাকে সাক্ষী রেখে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের প্রথা চালু করেছিল বলে অনুমান। সম্ভবত, সেই কারণেই এই মেলায় যুবক-যুবতীর মধ্যে মেলামেশা ও পছন্দের স্বীকৃতি দেয় পরিবার।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE