Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পায়ে বল, জীবন যুদ্ধে এগোচ্ছে সঞ্চিতারা

শালবনি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাল-মহুয়ার জঙ্গল। গ্রাম্য জীবনের ধারাপাত। কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে ইচ্ছেশক্তিকে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। বছর কয়েক হল জেলার মহিলা ফুটবল মানচিত্রে ঢুকে পড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই জনপদ। সেই পরিচিতির ক্ষেত্রে অনেকটা অবদান শালবনির বাসিন্দা বছর চোদ্দোর সঞ্চিতা মাহাতোর।

সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে সঞ্চিতা (লাল জার্সি)।  ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সতীর্থদের সঙ্গে মাঠে সঞ্চিতা (লাল জার্সি)। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

বরুণ দে
শালবনি শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৫ ০১:৫৪
Share: Save:

শালবনি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাল-মহুয়ার জঙ্গল। গ্রাম্য জীবনের ধারাপাত। কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে দারিদ্র্যকে উপেক্ষা করে ইচ্ছেশক্তিকে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। বছর কয়েক হল জেলার মহিলা ফুটবল মানচিত্রে ঢুকে পড়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই জনপদ। সেই পরিচিতির ক্ষেত্রে অনেকটা অবদান শালবনির বাসিন্দা বছর চোদ্দোর সঞ্চিতা মাহাতোর।

কে এই সঞ্চিতা মাহাতো?

কলসিভাঙা হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী সঞ্চিতা জেলার হয়ে মাঠে নেমে প্রথমেই সকলের নজর কেড়েছিল। তার বাবা কালোসোনা মাহাতো কাঠের কাজ করেন। মা প্রতিমাদেবী গৃহবধূ। সামান্য জমি রয়েছে। ধীরে ধীরে স্কুল ফুটবলে (অনুর্ধ্ব ১৪) রাজ্য দলের হয়ে খেলেছে সঞ্চিতা। সম্প্রতি গুয়াহাটির অসামে গিয়েছিল সে। গত বছর স্কুল ফুটবলে জেলার দল রাজ্যে রানার্স হয়েছিল। সুযোগ আসে রাজ্য দলে খেলারও। বছর তিনেক হল নিয়মিত ফুটবল খেলছে ছোট্ট মেয়েটা। পুরস্কারের ঝুলিও তার কম ভারি নয়। পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে ট্রফি, মেডেল, জার্সি-এমনই নানা কিছু। সঞ্চিতার কথায়, “পুরস্কার পেলে ভালই লাগে। বাড়িতে ৪টি বড় ট্রফি রয়েছে। ২টি বড় মেডেল রয়েছে। ৭- ৮টি ছোট মেডেল রয়েছে।” হেসে সঞ্চিতা জানায়, ফরোয়ার্ডই নিজের পছন্দের পজিশন। তবে দলের জন্য কখনও মিডফিল্ডে, কখনও ডিফেন্সে খেলতে হয়।

কিন্তু সঞ্চিতার এই যাত্রাপথও খুব একটা সহজ ছিল না। কোনও এক সময় মেদিনীপুর থেকে ট্রেন ধরতে হত সঞ্চিতাকে। বাইরে খেলা থাকলে বাবার সঙ্গে মোটরবাইক চেপে ভোররাতে পাথরির বাড়ি থেকে মেদিনীপুরে পৌঁছাত সে। ভোররাতে এতটা পথ পেরনো? হেসে কালোসোনাবাবুর উত্তর, “মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম তো!’’ সঙ্গে তিনি জানান, ওর মা-ও সব রকম ভাবে উৎসাহ দেয়। মেয়ে ভাল কিছু করলে আমাদের তো আনন্দ হয়ই।” বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল সঞ্চিতার বাবার। আর এখন তো এই খুদে ফুটবলারকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছেন ক্রীড়া-সংগঠকরাও। জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সম্পাদক সোমনাথ দাসের কথায়, “ওর মধ্যে প্রতিভা রয়েছে। ভাল প্রশিক্ষণ পেলে ও অনেক দূর এগোবে।” প্রাক্তন ফুটবলার অমিয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, “সঞ্চিতা আমারই ছাত্রী। ওর মধ্যে শেখার ইচ্ছে রয়েছে। প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। কিন্তু তার মধ্যেই খেলা চালিয়ে যাওয়াটাই তো চ্যালেঞ্জ।”

শালবনিতে মহিলা ফুটবল এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত বছর পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত জঙ্গলমহল কাপে ১১৩টি দল যোগ দিয়েছিল। এর মধ্যে মহিলাদের ৫৭টি, পুরুষদের ৫৬টি। স্থানীয়দের সাড়া পেয়ে প্রতি বছরই এমন প্রতিযোগিতার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সঞ্চিতাও মধুপুরের এক দলের হয়ে ফুটবল খেলত। পরে জেলার স্কুল ফুটবল দলে খেলার সুযোগ পায়। মেদিনীপুর (সদর) মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম-সম্পাদক সন্দীপ সিংহ জানান, একটা সময় নেহাতই খেলার জন্য ফুটবল খেলা হত। এখন রীতিমতো প্রশিক্ষক রেখে বছরভর প্রশিক্ষণ দিয়ে তবেই মেয়েদের মাঠে নামানো হয়। শালবনির এক এক ফুটবল ক্যাম্পের ইনচার্জ তাপস ঘোষের কথায়, “গত কয়েক বছরে মহিলা খেলোয়াড় সংখ্যা বেশ বেড়েছে। ফুটবল নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। আমরাও লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি।”

অবশ্য শালবনির সর্বত্র ভাল মাঠ নেই। ব্লক সদরে যে স্টেডিয়াম রয়েছে তারও সংস্কারের কাজ চলছে। প্রাক্তন ফুটবলার তথা ফুটবল-কোচ অমিয় ভট্টাচার্য বলেন, “আমি কোচিং করাতে পিঁড়াকাটায় যাই। যত বেশি প্রতিযোগিতামূলক খেলা হবে, তত ভাল। এমন প্রতিযোগিতামূলক খেলার মাধ্যমেই তো আরও বেশি প্রতিভা খুঁজে পাওয়া সম্ভব।” জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সম্পাদক সোমনাথ দাসও ফুটবলে মেয়েদের যোগদানের কথা অকপটে স্বীকার করছেন। তিনি বলেন, “অভিভাবকরা মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। উৎসাহ দিচ্ছেন। এটাই তো বড় আনন্দের কথা।” এলাকার ফুটবল নিয়ে আশাবাদী শালবনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নেপাল সিংহের কথায়, “শালবনি স্টেডিয়াম সংস্কার করা হয়েছে। আমরা উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।” শালবনির বিডিও জয়ন্ত বিশ্বাস বলেন, “এখানে ফুটবল টুর্নামেন্ট সংখ্যা আগের থেকে বেড়েছে। হাল ছেড়ে দিলে হবে না। সুযোগ পেলে নিজের সেরাটা তুলে ধরার চেষ্টা করতে হবে।”

সেই বিশ্বাসেই অজগাঁয়ের মাঠে প্রতিপক্ষকে গোলে বিধ্বস্ত করার মরিয়া লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মৌমিতা, অর্চনাদের মতো অনেক খুদে ফুটবলারই। সঞ্চিতা মাহাতোর দেখানো পথেই এগিয়ে চলছে পূজা মুদি, মৌসুমী মুর্মু, মৌমিতা মুর্মু, অর্চনা মুর্মুদের মতো খুদে ফুটবলাররা। এদের কেউ ইতিমধ্যে রাজ্যস্তরে সাফল্য পেয়েছে। এ বার জাতীয়স্তরে সাফল্য পাওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে। কেউ জেলাস্তরে সাফল্য পেয়েছে। আগামী দিনে জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়ে মুঠো মুঠো সাফল্য কুড়নোর স্বপ্ন দেখছে।

আর কী বলছে সঞ্চিতা? খুদে এই ফুটবলারের কথায়, “আমি আরও বড় হতে চাই। ভাল খেলতে চাই। প্রশিক্ষকেরা নানা ভাবে সাহায্য করেন। নাহলে হয়তো মাঠেই নামতে পারতাম না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shahor barun dey salboni
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE