Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মেলায় জখম কিশোর, ফুঁসছে বারচণ্ডীভেটি

তখনও বাড়চণ্ডীভেটি গ্রামের পিচ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্ত। এলাকার বাসিন্দাদের মুখগুলোও ভয়ে থমথমে। কেউ যেন কিছুতেই মানতে পারছেন না সামান্য মেলা দেখতে গিয়ে রাজনৈতিক রেষারেষির সম্মুখীন হতে হবে এলাকার বছর চোদ্দোর তরতাজা ছেলেটাকে। সোমবার রাতে বাড়চণ্ডীভেটি গ্রামে উল্টো রথের মেলায় ঘুরতে গিয়েছিল দীপক। হঠাৎই উল্টোদিকের থেকে আসা একটি গুলি তার মাথার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল।

উদ্বিগ্ন দীপকের দিদিমা ও দাদু।—নিজস্ব চিত্র।

উদ্বিগ্ন দীপকের দিদিমা ও দাদু।—নিজস্ব চিত্র।

সুব্রত গুহ
কাঁথি শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০০:০২
Share: Save:

তখনও বাড়চণ্ডীভেটি গ্রামের পিচ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রক্ত। এলাকার বাসিন্দাদের মুখগুলোও ভয়ে থমথমে। কেউ যেন কিছুতেই মানতে পারছেন না সামান্য মেলা দেখতে গিয়ে রাজনৈতিক রেষারেষির সম্মুখীন হতে হবে এলাকার বছর চোদ্দোর তরতাজা ছেলেটাকে।

সোমবার রাতে বাড়চণ্ডীভেটি গ্রামে উল্টো রথের মেলায় ঘুরতে গিয়েছিল দীপক। হঠাৎই উল্টোদিকের থেকে আসা একটি গুলি তার মাথার পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কাঁথির দেশপ্রাণ ব্লকের আমতলিয়া অঞ্চলের বাড়চণ্ডীভেটি গ্রামের তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্যার স্বামী কাশীরাম দাসের সঙ্গে তৃণমূলের বুথ কমিটির সম্পাদক খোকন জানার বিরোধের জেরেই এমন ঘটনা। কিন্তু সেই ঘটনায় তৃণমূলের কেউ জখম হয়নি। উল্টে জখম হয়েছে বছর চোদ্দোর সাধারণ এক কিশোর। দীপককে প্রথমে কাঁথি মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দীপকের বাবার বাড়ি মুণ্ডপাড়ায়। কিন্তু দীর্ঘদিন হল তিনি দীপকদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তাই দীপক ও তার বোন সুপ্রিয়া থাকে পাশের আউরাঁই অঞ্চলের ছনবেড়িয়া গ্রামে দাদু গৌরহরি ও দিদিমা রেনুকা গিরির কাছে। দীপকের দিদিমা রেণুকাদেবী জানান, দীপকের মা মনিমালাদেবী রুজির টানে কলকাতাবাসী। তিনি সেখানে পরিচারিকার কাজ করেন। দীপক ও সুপ্রিয়া স্থানীয় ঘোড়াঘাটা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিও সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া।

দীপকের দাদু গৌরহরিবাবু জানান, সোমবার রাতে বন্ধুদের সঙ্গে রথের মেলায় গিয়েছিল দীপক। হঠাৎই রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ দীপকের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান মেলা প্রাঙ্গণে। কিন্তু গুলির আওয়াজে মেলা তখন ছত্রভঙ্গ। তিনি বলেন, “শুনলাম ওকে কাঁথি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না।” দীপককে কে গুলি করেছে তা তিনি দেখেন নি। তবে শুনেছেন এলাকার তৃণমূল নেতা কাশীরাম দাসের বাড়ি থেকে আসা গুলিতেই দীপক জখম হয়েছে।

কাশীরামের সঙ্গে তৃণমূলের বুথ কমিটির সম্পাদক খোকন জানার বিরোধ মূলত নব্য-পুরনো তৃণমূলের দ্বন্দ্ব ঘিরে। এক সময়ে প্রবীণ সিপিআই নেতা মহসিন দপ্তরীর নেতত্বে সিপিআইয়ের গড় হিসেবে পরিচিত ছিল আমতলিয়া অঞ্চল। নন্দীগ্রাম-খেজুরি পর্বে শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে ক্রমশ এই এলাকায় একচেটিয়া ক্ষমতায় আসতে শুরু করে তৃণমূল। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালের মে মাস নাগাদ রাধারানিদেবী, তাঁর স্বামী কাশীরাম দাস-সহ আরও কয়েকজন সিপিআই কর্মী। সেই দলে ছিলেন মহসিন দপ্তরীর ছেলে জাইদুল হক দপ্তরীও। অভিযোগ, এলাকায় বন্দুকবাজ হিসেবে পরিচিত কাশীরাম-সহ রাধারানিদেবীদের দলে জায়গা দিতে আপত্তি জানিয়েছিলেন ওই এলাকার পুরনো তৃণমূল কর্মীরা। সেই দলে ছিলেন তৃণমূলের বুথ সম্পাদক খোকন জানাও। তবে শেষ পর্যন্ত রাধারানিদেবী তৃণমূলে যোগ দেন। এমনকী কাঁথি দেশপ্রাণ ব্লকের বাড়চণ্ডীভেটি গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের হয়ে টিকিট পেয়ে জয়লাভও করেন তিনি। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কাশীরামবাবুর সঙ্গে এলাকার পুরনো তৃণমূল কর্মীদের মতবিরোধ বাড়তে থাকে। খোকন ও কাশীরামবাবুর দু’জনেরই বাগদা চাষের ব্যবসা রয়েছে। ফলে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক দুই বিষয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমশ বিরোধ বাড়ছিল খোকনের সঙ্গে কাশীরামবাবুর। তার জেরেই এমন ঘটনা মানছে রাজনৈতিক মহলও।

কথায় বলে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। প্রবচনকে এভাবে চোখের সামনে সত্যি হতে দেখে কথা হারিয়ে ফেলেছেন এলাকার বাসিন্দারাও। তাই সোমবার রাতেই উত্তেজিত জনতা কাশীরাম দাসের ভেড়ি সংলগ্ন ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল মোটরবাইক, বাগদা চাষের জন্য মজুত রাখা খাবার-সব কিছু। এই আগুন এলাকার বাসিন্দাদের এক রকমের প্রতিবাদই। কিন্তু তারপরও ভয় যে যায় না। দীপকের দাদু-দিদিমা তাই চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “রাজনৈতিক দলের রেষারেষির জেরে আমাদের নাতিটার এমন অবস্থা হল। কারোর বাড়ির সন্তানকে এমন অবস্থায় না পড়তে হয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE