Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রাস্তা জুড়ে গাড়ির দখলদারি, যানজটে নাভিশ্বাস মেদিনীপুরে

দু’পাশে গজিয়ে ওঠা দোকানের চাপে এমনিতেই রাস্তার পরিসর কমেছে। রয়েছে রাস্তা আটকে গাড়ি, মোটর বাইক রাখার প্রবণতা। ফলে, যানজট মেদিনীপুর শহরের নিত্যকার সমস্যা। সঙ্গে গাড়ির ধোঁয়া, হর্নের দাপটে নাভিশ্বাস উঠছে শহরবাসীর।

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪৬
Share: Save:

দু’পাশে গজিয়ে ওঠা দোকানের চাপে এমনিতেই রাস্তার পরিসর কমেছে। রয়েছে রাস্তা আটকে গাড়ি, মোটর বাইক রাখার প্রবণতা। ফলে, যানজট মেদিনীপুর শহরের নিত্যকার সমস্যা। সঙ্গে গাড়ির ধোঁয়া, হর্নের দাপটে নাভিশ্বাস উঠছে শহরবাসীর।

শহরের কলেবর বেড়েছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বসতি, একের পর এক বহুতল মাথা তুলছে। অথচ এতদিনেও জেলার সদর শহরে গাড়ি রাখার সুষ্ঠু কোনও বন্দোবস্ত গড়ে ওঠেনি। কেরানিতলা থেকে বটতলা, স্কুলবাজার থেকে রাজাবাজার, এলআইসি থেকে সিপাইবাজার রাস্তার যত্রতত্র গাড়ি পার্কিংয়ের ছবি দেখা যায় সর্বত্রই। প্রবীণ নাগরিক চপল ভট্টাচার্য সেই পঞ্চাশের দশক থেকে মেদিনীপুর শহরকে দেখছেন। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক চপলবাবুর কথায়, “তখন মেদিনীপুর সত্যিই শান্ত শহর ছিল। পথঘাট কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত। শহরের মানুষও অনেক বেশি সচেতন ছিলেন।” আর এখন তো রাস্তায় গাড়ি রাখাটাই দস্তুর। এ নিয়ে আগে একাধিক ব্যাঙ্কে নোটিসও দিয়েছে মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদ (এমকেডিএ)। তবু হাল ফেরেনি।

সমস্যা যে রয়েছে, তা মানছেন পুর-কর্তৃপক্ষও। মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসুর কথায়, “এটা ঠিক, শহরে গাড়ি পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট জায়গা নেই। পুরসভার জায়গা নেই বলেই এই ব্যবস্থা করা যায়নি।” মেদিনীপুরে এখন মার্কেট কমপ্লেক্সও তৈরি হয়েছে। কমপ্লেক্সে কেনাকাটা করতে যাঁরা আসেন, তাঁরাও গাড়ি রাখেন সেই রাস্তা দখল করেই। পুরসভা ব্যবস্থা নেয় না কেন? পুরপ্রধান জানালেন, পুরসভার কাছে বহুতল তৈরির অনুমতি নেওয়া হয়। পরে সেখানে ব্যবসা করা হলে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়। ফলে, গোড়াতেই বোঝার সুযোগ থাকে না কোথায় মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হবে। সেই সঙ্গে পুরপ্রধানের বক্তব্য, “অবৈধ পার্কিং এড়াতে কিছু পদক্ষেপ হয়। তবে মেদিনীপুরের মতো ছোট শহরে এই সমস্যা কম হলেও থাকবে!”

দীর্ঘদিন ধরেই যানজটে নাজেহাল শহর মেদিনীপুর। শহরে আলাদা করে কোনও ফুটপাথ নেই। বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয়। যত দিন যাচ্ছে, ততই সংকীর্ণ হচ্ছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো। দু’পাশে মাথা তুলছে একের পর এক ছোট ছোট দোকান। পরিস্থিতি দেখে সম্প্রতি শহরে এসে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোয় ফুটপাথ অর্থাত্‌ পাথওয়ে তৈরির নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সেই নির্দেশমতো আলাদা ফুটপাত তৈরি করা যাবে কি না, সংশয় রয়েছে তা নিয়েও। কারণ, শহর এখন হকার-সমস্যায় জেরবার। হকারদের বেআইনি দখলদারি তুলে দিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণ বা ফুটপাথ তৈরি এক অর্থে সম্ভব নয়। শহরবাসী অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, বছর পাঁচেক আগে যে সব রাস্তা সম্প্রসারিত হয়েছিল, এখন ফের তা হকারদের দখলে চলে গিয়েছে। আর যে সব রাস্তা সম্প্রসারিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা মাপজোকেই থমকে রয়েছে।

শহরের রাস্তার দু’দিকে দখলদারির চেহারাটা ঠিক কী রকম?

কোথাও লরি-ম্যাটাডোর-ট্যাক্সি স্ট্যান্ড রয়েছে। কোথাও আবার পোশাকের দোকান, ফলের দোকান, চা দোকান রয়েছে। বেআইনি পার্কিং তো রয়েছেই। শহরের মধ্যে কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড রয়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের উপর দিয়ে প্রায় ৮০০টি বাস চলাচল করে। প্রায় ৫০০টি বাস শহর ছুঁয়ে যায়। সঙ্গে রয়েছে অটো-রাজ!

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সদর শহর মেদিনীপুর। জেলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ রোজ নানা কাজে শহরে আসেন। জেলা কালেক্টরেট, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভিড় লেগেই থাকে। তা ছাড়া, শহরে জনসংখ্যাও বেড়েছে। অর্থাত্‌ সব মিলিয়ে চাপ বেড়েছে রাস্তার উপর। কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাস্তাঘাটের হাল ফেরেনি। মেদিনীপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে জজকোর্ট রোড, কেরানিতলা, স্টেশন রোড, কালেক্টরেট মোড়, গাঁধী স্ট্যাচু মোড়, বটতলাচক, গোলকুয়াচক, সিপাইবাজার অন্যতম। গোলকুয়াচক-ধর্মা সংকীর্ণ রাস্তায় তো মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে।

যানজট ঠেকাতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত শহরের মধ্যে বড় লরি ঢুকতে পারবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত খাতায়-কলমেই থেকে গিয়েছে। পুলিশি নজরদারির ফাঁক গলে কী সকাল, কী দুপুর, শহরে লরি ঢোকা আটকানো যায়নি। শহরের বাসিন্দা তথা আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকতের দাবি, “গত ৮ বছরে এই রাস্তায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২৪ জন মারা গিয়েছেন। ৯ জন গুরুতর জখম হয়েছেন।”

শহরের রাস্তায় ছোট-বড় গাড়ির সংখ্যাও আগের থেকে বেড়েছে। সব থেকে বেশি বেড়েছে মোটর বাইক। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া তরুণরাও মোটর বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চলে এসেছে। সদর শহরে প্রায় সব মোটর বাইক প্রস্তুতকারী সংস্থার নিজস্ব ডিলার রয়েছে। শো-রুমও রয়েছে। বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থাও যুবকদের ঋণ দিয়ে বাইক কিনতে সাহায্য করছে। ফলে, দিনে দিনে শহরে মোটর বাইকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ছোট-বড় গাড়ির সংখ্যা শহরের রাস্তাগুলোর হাল সে ভাবে ফেরেনি। কিছু রাস্তা এবড়ো-খেবড়ো। পিচের প্রলেপ উঠে গিয়েছে। ধর্মার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই সড়ক দিয়ে ভারী গাড়ি চলাচল করে। খড়গপুর বা কেশপুরের দিক থেকে যে সব গাড়ি শহরে ঢোকে, তার অধিকাংশই ধর্মা পেরিয়ে কর্নেলগোলা দিয়ে যাতায়াত করে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকা অধিকাংশ সময়ই ব্যস্ত থাকে। জেলায় ট্রাফিক পুলিশের দু’টি ইউনিট রয়েছে। একটি মেদিনীপুরে। তা-ও এই পরিস্থিতি!

সমস্যার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সকলেই। এমকেডিএ-র চেয়ারম্যান তথা মেদিনীপুরের বিধায়ক মৃগেন মাইতি বলেন, “শহরে যানজট সমস্যা রয়েছে, এটা ঠিক। সমস্যার সমাধানে চেষ্টাও চলছে।” তাঁর কথায়, “এমকেডিএ থেকে আগে একাধিক ব্যাঙ্ককে নোটিস দিয়েছি। বলেছি, গ্রাহকদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করুন। রাস্তায় গাড়ি রাখা যাবে না।” উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ জানান, কিছু রাস্তায় পাথওয়ে তৈরি হবে। আর মেদিনীপুরের (সদর) মহকুমাশাসক অমিতাভ দত্তের আশ্বাস, “যানজট সমস্যা কী ভাবে এড়ানো যায়, আলোচনা করেই পদক্ষেপ করা হবে।”

সমস্যা এড়ানো গেল কি না, সময়েই তার উত্তর মিলবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

traffic congesion problem medinipur barun dey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE