শহরের একটা দিক। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
জেলার অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র হয়েও আজও পুরসভার মর্যাদা পেল না অরঙ্গাবাদ।
গ্রাম পঞ্চায়েতের খোলস ছেড়ে পুরসভায় উত্তীর্ণ হোক অরঙ্গাবাদ, স্থানীয় বাসিন্দাদের এই দাবি বহু পুরানো। তবুও কোনও অজ্ঞাত কারণে বারবার বঞ্চিত হচ্ছে এই শহর। পুরসভার দাবি জানিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট-সহ প্রস্তাবিত শহরের নকশাও রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এমনকী বাজার এলাকায় পঞ্চায়েত সমিতির পরিত্যক্ত মার্কেট কমপ্লেক্সকে পুর-ভবন হিসেবে গড়ারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস কিংবা বাম সরকার কেউই কথা রাখেনি।
“মোগল আমলে যুদ্ধ জয়ের স্মারক হিসেবে গড়ে ওঠা অরঙ্গাবাদ একসময় ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের ঝড় আছড়ে পড়েছিল অরঙ্গাবাদে। সেই গণআন্দোলনকে থামাতে ইংরেজ শাসকেরা সামরিক আইন জারি করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। ১৮৫৬ সালে তত্কালীন ঔরঙ্গাবাদ থেকে মহকুমা সদর স্থানান্তরিত করা হয় জঙ্গিপুরে। তারপর দেড়শো বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। তবু আজও শহরের মর্যাদা পেল না বহু ইতিহাসের সাক্ষী অরঙ্গাবাদ।” আক্ষেপ কলেজপাড়ার বাসিন্দা শিক্ষক মহম্মদ সামসুদ্দিনের।
অরঙ্গাবাদের এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও কসুর করেননি সিপিএম জেলা কমিটির সদস্য অমল চৌধুরীও। তাঁর ক্ষোভ, “দলেরই দখলে থাকা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতি সব জায়গায় অরঙ্গাবাদকে শহর হিসেবে গড়ার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। বাম জমানায় জগতাই ও অরঙ্গাবাদের দু’টি করে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা, প্রায় ৩৫ হাজার বাসিন্দা, ১৯টি ওয়ার্ডের এক পুর-বিন্যাসের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল রাজ্য সরকারের কাছে। এক সময় সম্ভাব্য পুরসভার তালিকায় ঠাঁইও পেয়েছিল অরঙ্গাবাদ। কিন্তু তারপরেও কেন তা বাস্তাবায়িত হল না দলের নেতা হয়েও আজও আমি তা জানতে পারলাম না।”
অরঙ্গাবাদ পুরসভার মর্যাদা না পাওয়ায় অরঙ্গাবাদের বাসিন্দা ব্লক কংগ্রেস সভাপতি আলফাজুদ্দিন বিশ্বাসও একই ভাবে ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, “এক সময় আমি সুতি-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলাম। সেই সময়ে অরঙ্গাবাদ পুরসভার জন্য প্রস্তাবিত খসড়া পাশ করিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে মধুপুর গ্রামটিকে বাদ রেখে জগতাই ও অরঙ্গাবাদের ৪টি পঞ্চায়েত এবং বাজিতপুরের পুড়াপাড়া ও মহেশাইলের কয়াডাঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করে নকশা তৈরি করা হয়। তাতে প্রায় ৩০ হাজার বাসিন্দার প্রস্তাবিত অরঙ্গাবাদ পুরসভায় রাখা হয় ১৮টি ওয়ার্ড। মৌজা ম্যাপ তৈরি করে আমি নিজে রাজ্যের তত্কালীন পঞ্চায়েত সচিব মানবেন্দ্রনাথ রায়ের হাতে। তিনি তা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়েও দেন। কিন্তু এরপর আর কোনও খবর নেই।”
অরঙ্গাবাদ তাঁতিপাড়ার বাসিন্দা সিপিএমের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য পলাস দাস জানান, অরঙ্গাবাদকে পুরসভা করার সর্বশেষ প্রস্তাব গেছে ২০১১ সালে। পঞ্চায়েত সমিতি নিজে উদ্যোগী হয়ে সভা ডাকে। তাতে হাজির ছিলেন অরঙ্গাবাদ ও জগতাই-এর ৪টি পঞ্চায়েতের সমস্ত দলের সদস্য। প্রধান ও রাজনৈতিক নেতারা সর্বসম্মত ভাবে প্রস্তাব পাশ করিয়ে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের কাছে। তবু সাড়া মেলেনি। সুতি-২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি কংগ্রেসের কাওসার আলি অরঙ্গাবাদেরই দেবীপুরের বাসিন্দা। তিনি বলেন, “পুরসভা হওয়ার সব যোগ্যতা রয়েছে অরঙ্গাবাদের। ছোট বড় মিলিয়ে ৩০টিরও বেশি বিড়ি কারখানা রয়েছে। দু’টি বড় বাজার রয়েছে। কয়েক হাজার দোকান রয়েছে। ছোটবড় বহুতলে ছেয়ে গিয়েছে গোটা অরঙ্গাবাদ।” তাঁর কথায়, “মুর্শিদাবাদ জেলার মধ্যে সব চেয়ে বড় বাণিজ্য কেন্দ্র এটি। বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা চলে এখানে। যদি পুরসভা হয় তা হলে জেলার অন্য ৭টি পুরসভার চেয়ে অনেক বেশি পুর কর আদায়ের সুযোগ রয়েছে অরঙ্গাবাদে। এর সঙ্গে পুর উন্নয়নের জন্য সরকারি সাহায্য পাওয়া গেলে অরঙ্গাবাদের আর্থ সামাজিক পরিবেশটাই বদলে যাবে।”
জগতাই-১ পঞ্চায়েতের প্রধান যাদব সিংহ জানান, অরঙ্গাবাদ অনেক পরিচ্ছন্ন জনপদ। পঞ্চায়েতের আর্থিক সীমাবদ্ধতার ফলে পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা, সড়ক, পরিবহণ নিয়ে সমস্যা থাকলেও অরঙ্গাবাদ এ বিষয়ে অনেক সচেতন। বেশির ভাগ পরিবারেরই শৌচাগার রয়েছে। তাঁর কথায়, “১৯৬৭ সালে বিড়ি মালিকদের সাহায্যে কমার্স কলেজ গড়ে উঠেছে অরঙ্গাবাদে। রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএড ও বেসিক ট্রেনিং মিলিয়ে ছয়টি বেসরকারি কলেজ। রয়েছে ৬টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তবুও কেন অরঙ্গাবাদ পুরসভার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত সে প্রশ্ন আমারও।” ব্যাঙডুবির মোড়ে দাঁড়িয়ে তেনাউড়ির বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী আনিসুর রহমান উগরে দিলেন যাবতীয় ক্ষোভ। তিনি বলেন, “পুরসভা হলে অন্তত রাস্তাঘাট জবর দখলের হাত থেকে বাঁচত।”
তবে অরঙ্গাবাদের শহর না হয়ে ওঠার পিছনে বিড়ি ব্যবসায়ীদের হাত দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “অরঙ্গাবাদ শহর হলে পুর-করের বিশাল আর্থিক বিশাল বোঝা চাপবে বিড়ি কারখানার মালিকদের উপর। তাঁদের বিশাল বিশাল ইমারতগুলি যেমন পুর-করের আওতায় আসবে তেমনি সরকারি জমি জবর দখলের কোপও পড়বে অনেকের ঘাড়েই। সেই কারণে অনেকে শহর গড়ে ওঠার পথে বাধা দিচ্ছেন।” অরঙ্গাবাদ ডিএন কলেজের অধ্যাপক সাধন দাসের কথায়, “কী বাম, কী ডান সব আমলেই সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল একাধিক বিড়ি মালিকদের। তাঁরা আন্তরিক ভাবে উদ্যোগী হলে হয়তো শহরের মর্যাদা থেকে পিছিয়ে থাকতে হত না অরঙ্গাবাদকে।” অভিযোগ অবশ্য মানতে রাজি নন অরঙ্গাবাদ বিড়ি মালিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রাজকুমার জৈন। তিনি বলেন, “এলাকার প্রতিটি বিড়ি মালিকই চান অরঙ্গাবাদ শহর হিসেবে গড়ে উঠুক। আমরাও বার বার এ নিয়ে দাবি তুলেছি। অরঙ্গাবাদ শহর হলে এলাকার পরিবহণ-সহ যোগাযোগের সুবিধা বাড়বে। শিক্ষার আরও প্রসার হবে। ব্যবসা বাণিজ্যের সুযোগ বাড়বে।”
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য জানান, বছর আড়াই আগে অরঙ্গাবাদকে পুরসভা করার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এলাকার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে দাবি-পালটা দাবির জেরে সে সিদ্ধান্ত স্থগিত হয়ে যায়।” সুতির তৃণমূল বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস বলেন, “অনেক আগেই অরঙ্গাবাদের শহরের মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বামফ্রন্টের উপেক্ষার শিকার হয়েছি আমরা। এ নিয়ে বর্তমান পুর-মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর কিন্তু সেই আশ্বাসেও যে বিশেষ ভরসা রাখতে পারছে না অরঙ্গাবাদ।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ,
জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy