Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

চোলাইয়ের কারবার চলছেই, উদাসীন প্রশাসন

আবগারি দফতরের অভিযান চলে। মাঝেমধ্যে গর্জে ওঠেন পড়শিরা। কোমর বেঁধে চোলাইয়ের ঠেকও ভেঙে দেয় প্রমীলা বাহিনী। পুলিশ প্রশাসনও হঠাত্‌ করে অতি সক্রিয় হয়ে দু’-চার জনকে ধরপাকড় করে। ‘সমাজ কলুষিত হচ্ছে’ বলে সরব হন রাজনীতির কারবারিরাও। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তারপর হইচই থিতিয়ে গেলে ফের শুরু হয় চোলাইয়ের চেনা কারবার। মুর্শিদাবাদ ও পড়শি জেলা, নদিয়ায় চোলাই-চিত্র কমবেশি এমনটাই।

বিমান হাজরা
সাগরদিঘি শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:১১
Share: Save:

আবগারি দফতরের অভিযান চলে। মাঝেমধ্যে গর্জে ওঠেন পড়শিরা। কোমর বেঁধে চোলাইয়ের ঠেকও ভেঙে দেয় প্রমীলা বাহিনী। পুলিশ প্রশাসনও হঠাত্‌ করে অতি সক্রিয় হয়ে দু’-চার জনকে ধরপাকড় করে। ‘সমাজ কলুষিত হচ্ছে’ বলে সরব হন রাজনীতির কারবারিরাও। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। তারপর হইচই থিতিয়ে গেলে ফের শুরু হয় চোলাইয়ের চেনা কারবার। মুর্শিদাবাদ ও পড়শি জেলা, নদিয়ায় চোলাই-চিত্র কমবেশি এমনটাই।

গত শুক্রবার মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির দেবগ্রামে গণেশ মিস্ত্রি (৪৫), হারাধন দাস ( ৪৬) ও গয়ানাথ দাস (৪৪) নামে তিন বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের পরিবার ও গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ, ওই তিন জনের মৃত্যু হয়েছে চোলাই মদ খেয়ে। গ্রামবাসীদের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে শনিবার সকাল থেকেই বেপাত্তা স্থানীয় চোলাই কারবারি সনাতন দাস। এ দিন পুলিশ সনাতনের বাড়িতে গিয়ে চোলাই ও চোলাই তৈরির বেশ কিছু সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করেছে। সাগরদিঘির ওসি পিন্টু মুখোপাধ্যায় বলেন, “সনাতনকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। এর আগেও বেশ কয়েকবার চোলাইয়ের কারবারের জন্য তাকে ধরাও হয়েছিল। গোটা ঘটনাটিই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”

গ্রামবাসীদের ক্ষোভ, এখন পুলিশ সনাতনকে খুঁজতে দৌড়ঝাঁপ করছে। এতদিন তো সব জেনেও তারা ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিল। স্থানীয় একটি ক্লাবের কর্তা সন্তু প্রামাণিক বলছেন, “অন্তত ১৫ বছর ধরে দেবগ্রামের এই চোলাইয়ের ঠেক চলছে। সে কথা পুলিশ প্রশাসনেরও অজানা নয়। বহু বার আমরা ও গ্রামের মহিলারা গিয়ে সেই ঠেক ভেঙে দিয়েছি। পুলিশকেও বিষয়টি জানাতে গেলে উল্টে শুনতে হয়েছে, ‘তোমরা গিয়ে ভেঙে দাও, আমরা সঙ্গে আছি।’ বলুন তো, এটা কি পুলিশের কথা হল?”

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই তিন জনই নয়, গত ২০ ডিসেম্বর চোলাই খেয়েই মারা গিয়েছেন আরও তিন জন। তবে স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য মৃত্যুর কারণ জানে না। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “বিষ মদ খেয়ে মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে মৃতদের ময়নাতদন্ত করা হয়নি বলেই মৃত্যুর সঠিক কারণ আমরাও বলতে পারছি না।” তবে মৃতদের পরিবার ও গ্রামবাসীদের একাংশ সমস্বরে বলছেন, “পুলিশ কিংবা স্বাস্থ্য দফতর যাই বলুক না কেন ওরা সকলেই মারা গিয়েছে ওই বিষ মদ খেয়েই।

ঘটনাচক্রে এই দেবগ্রামেই বাড়ি সিপিএমের সাগরদিঘি জোনাল কমিটির সম্পাদক জ্যোতিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কংগ্রেসের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বরূপ মুখোপাধ্যায় ও তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা সেলের সাগরদিঘির সভাপতি সুভাষ দত্তের। কোনও রাখঢাক না করেই জ্যোতিরূপবাবু বলছেন, “শুধু এই দেবগ্রামেই নয়, গোটা সাগরদিঘি জুড়ে কমবেশি দু’শোরও বেশি চোলাইয়ের ঠেক চলছে রমরমিয়ে। আর পুলিশ প্রশাসনই বা কী করবে? কারণ, এই ঠেকের কারবারিদের সিংহভাগই শাসক দলের নেতাদের তুষ্ট করে চলেন।”

স্বরূপবাবুর অভিযোগ, “আবগারি দফতর বলে যে একটা দফতর আছে সেটাই তো জানেন না এলাকার মানুষ। কস্মিনকালেও এই গ্রামে তাদের পা পড়েনি। পুলিশ, আবগারি দফতর ও শাসক দলের প্রশ্রয়েই এই চোলাইয়ের এত বাড়বাড়ন্ত।” তবে তৃণমূলের সুভাষবাবু অবশ্য বলছেন, “চোলাইয়ের পিছনে এ ভাবে রাজনীতির রং খোঁজাটা ঠিক নয়। তবে এটা ঠিক, যে পুলিশ ও আবগারি দফতর সক্রিয় হলে চোলাইয়ের এত রমরমা হত না, এড়ানো যেত এই ছ’জনের মৃত্যুর ঘটনাও।

অন্য দিকে, নদিয়ার কল্যাণী, রানাঘাট, শিমুরালি, নাকাশিপাড়া, কালীনারায়ণপুর বাজার-সহ ধুবুলিয়ার সাধনপাড়ার মতো বেশ কিছু এলাকায়তেও চোলাইয়ের কারবার চলছে অবাধে। নদিয়ার আবগারির দফতরের সুপার দীপককুমার নাহা বলেন, “চোলাইয়ের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালাচ্ছি। পথ নাটিকার মাধ্যমেও লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক যে, এখনও পর্যন্ত জেলাকে একেবারে চোলাইমুক্ত করা যায়নি।”

দেবগ্রামের ওই ঘটনার পরে রবিবার নবগ্রাম-সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়েছে আবগারি দফতর। ওই দফতরের এক কর্তা বলেন, “চোলাইয়ের কারবার বন্ধ করতে আমরাও কড়া নজরদারি চালাচ্ছি।”

এই ‘কড়া’ নজরদারি সত্ত্বেও সাগরদিঘি, ফরাক্কা, সামসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুতি ও রঘুনাথগঞ্জের মতো এলাকায় চোলাইয়ের ঠেকগুলো তবে চলছে কী ভাবে? বলাই বাহুল্য, সে প্রশ্নের অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি।

(সহ প্রতিবেদন: মনিরুল শেখ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE