Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পানীয় জলের সঙ্কটে অবৈধ জলের ব্যবসা

পানীয় জলের তীব সঙ্কট। আর সেই সুযোগ নিয়েই একের পর এক বেআইনি বটলিং প্ল্যান্ট গড়ে উঠছে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে। নিতান্ত ‘জলের দরে’ সে সব বিক্রি হচ্ছে বাজারে। স্থানীয় মানুষ কিনেও নিচ্ছেন ২০ লিটারের জ্যারিকেন। অথচ এই সব কোম্পানির না আছে সরকারি অনুমতি, না আছে ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস-এর (আইএসআই) শংসা। আইএসআই-র মানক চিহ্ন থাকাটা যে দরকার, সে কথা জানেনও না অনেকে।

বিমান হাজরা
ধুলিয়ান শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৪ ০০:২৬
Share: Save:

পানীয় জলের তীব সঙ্কট। আর সেই সুযোগ নিয়েই একের পর এক বেআইনি বটলিং প্ল্যান্ট গড়ে উঠছে মুর্শিদাবাদ জেলা জুড়ে। নিতান্ত ‘জলের দরে’ সে সব বিক্রি হচ্ছে বাজারে। স্থানীয় মানুষ কিনেও নিচ্ছেন ২০ লিটারের জ্যারিকেন। অথচ এই সব কোম্পানির না আছে সরকারি অনুমতি, না আছে ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস-এর (আইএসআই) শংসা। আইএসআই-র মানক চিহ্ন থাকাটা যে দরকার, সে কথা জানেনও না অনেকে।

ধুলিয়ান-সহ সামশেরগঞ্জ ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকায় পুরসভার সরবরাহ করা ভূগর্ভস্থ জলের সুবিধা পান মাত্র ৩০ শতাংশ এলাকাবাসী। বাকিদের ভরসা নলকূপ। সেই নলকূপও যে সব সময় কাজ করে তা নয়। ফলে বাধ্য হয়েই এলাকাবাসী নিয়মিত কিনে নিয়ে যান ২০ লিটারের ‘মিনারেল ওয়াটার’। শহরের বাসিন্দা কল্যাণ গুপ্ত বলেন, “এমনিতে নামী কোম্পানির পরিশুদ্ধ পানীয় জলের দাম অনেক বেশি। ২০ লিটার জলের দাম পড়ে প্রায় ৯০ থেকে ১০০ টাকা। কিন্তু এই সব স্থানীয় কোম্পানির জল ৩৫ টাকাতেই পাওয়া যায়। রোজের সংসারে জল তো লাগেই।”

এই নিত্য প্রয়োজনীয়তাকে কাজে লাগিয়েই ব্যবসায় নেমেছে বেশ কিছু অসাধু চক্র। ইসলামপুর, ডাকবাংলো, ধুলিয়ান শহরের আশপাশে রমরমিয়ে চলছে বটলিং প্ল্যান্ট। খুব সস্তায় গভীর নলকূপের জল জ্যারিকেনে ভরে ছোট ছোট গাড়িতে পৌঁছে যায় চাঁদপুর, ভাসাই পাইকর, দোগাছির বাজারে। প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে চার হাজার জ্যারিকেন বিক্রি হয় গোটা এলাকায়। এভাবে প্রতি ২০ লিটারে লাভ হয় প্রায় ২৫ টাকা।

মুর্শিদাবাদে একটি নামী ‘মিনারেল ওয়াটার’ কোম্পানির কর্তা বলেন, “সরকারি নিয়ম মেনে, আইএসআই-র লাইসেন্স নিয়ে বটলিং প্লান্ট চালাতে গেলে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। ১৫০০ বর্গ গজ জমিতে থার্মাল শিটের ছাদ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও সিলিন্ডার রুম, দু’টি জল পরীক্ষাগার, স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি জলের পাইপ ও রিজার্ভার, জ্যারিকেন ও বোতল রাখার পৃথক ঘর প্রভৃতি না থাকলে মেলে না অনুমোদন। তাছাড়া পরিশোধন ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামো স্বাস্থ্যসম্মত কিনা তা খতিয়ে দেখতে প্রতি দু’মাস অন্তর পরিদর্শনে আসেন আইএসআই-র প্রতিনিধি দল। এই ভাবে একটি বটলিং প্ল্যান্ট গড়তে কমপক্ষে ৩০-৩৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয়।

কিন্তু অনুমোদনহীন প্রকল্পগুলিতে স্রেফ একটা গভীর নলকূপ বসিয়ে নিলেই কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে। নলকূপের জল রিজার্ভারে রেখে সরাসরি জারিকেনে ভরা হচ্ছে। লাখ দুয়েক টাকা খরচ করলেই একটা ছোট্ট খুপরি ঘর হয়ে উঠছে বটলিং প্ল্যান্ট। এই সব কোম্পানি আবার এক বা দু’লিটারের জলের বোতল তৈরি করে না। ২০ লিটারের এক একটি জ্যারিকেনে উৎপাদন খরচ পড়ে বড়জোর চার টাকা। পরিবহন বাবদ এক টাকা খরচ ধরলে ২৫ টাকাই লাভ। এভাবে প্রতিদিন গড়ে ২০০টি করে জ্যারিকেন বিক্রি করতে পারলেই দৈনিক লাভ ৫ হাজার টাকা।

ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস সার্টিফিকেশন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরের জারি করা কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ অনুসারে আইএসআই ছাপ ছাড়া কোনও ভাবেই কেউ বোতলবন্দি জল তৈরি বা বিক্রি করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ভেজাল নিরোধক আইনে মামলা করতে পারে পুলিশ। এই কড়া দাওয়াই প্রয়োগে এক সময় ফল মিলেছিল। অনুমোদনহীন বহু বটলিং প্ল্যান্টই বাধ্য হয় বুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস সার্টিফিকেশন দফতরের কাছ থেকে অনুমতি নিতে। হিসেব দেখা যায় ২০০২ সালে সারা দেশে এই ধরনের বটলিং প্ল্যান্টের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫০টি। বর্তমানে সেই সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০০। কিন্তু তারপরেও অনুমোদনহীন বহু সংস্থা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদ-সহ গোটা রাজ্যে।

আর্সেনিক প্রভাবিক মুর্শিদাবাদে যত্রতত্র নলকূপ বসানোর ক্ষেত্রেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সে সব বিধিনিষেধও এই সব সংস্থাগুলি মানছে কি না তা দেখার কেউ নেই। ফলে নিরাপদ পানীয় ভেবে পয়সা দিয়ে মানুষ যা কিনে খাচ্ছেন তা আদৌ নিরাপদ কিনা তা নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। এ বিষয়ে মানুষের সচেতনার উপরেই বিশ্বাস রাখতে চাইছেন ধুলিয়ানের অনুপনগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক সজল পণ্ডিত। তিনি বলেন, “এই সব জল এত সস্তায় পরিশোধিত হয় যে সন্দেহ হয়, সেগুলো আদৌ পরিশোধিত কিনা। যেহেতু গভীর নলকূপের জল তাই স্বচ্ছ হয়। তাতেই খুশি মানুষ। কিন্তু সরকারি মানক চিহ্নের বিষয়ে মানুষ যদি সচেতন না হয় তাহলে কী করা যাবে!” ধুলিয়ানের উপ-পুরপ্রধান তৃণমূলের দিলীপ সরকার পুরসভা এলাকার বাইরে রয়েছে বলে দায় এড়াতে চান। তিনি বলেন, “এই সব বেআইনি বটলিং প্ল্যান্টগুলি পুর এলাকার বাইরে। তাছাড়া পুরসভা বা পঞ্চায়েতের হাতে এমন কোনও আইন নেই যার বলে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। একবার পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জলের ব্যবসা। অন্য দিকে সামশেরগঞ্জের বিডিও পার্থপ্রতিম দাস জানান, “আমি সম্প্রতি সামশেরগঞ্জে এসেছি। খোঁজ নিয়ে দেখছি কারা এক সঙ্গে জড়িত। বে-আইনি হলে ব্যবস্থা নেব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

drinkijg water biman hazra dhulian
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE