পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তথা শিক্ষিকা শামসুন্নাহার হক বলেন, “বাড়ির সামনে ট্যাপকল রয়েছে। কিন্তু পাইপ লাইনে কোনও জল আসে না। ট্যাপকলের ভরসা ছেড়ে দিয়ে তাই এলাকার বাসিন্দারা ২০ লিটারের মিনারেল ওয়াটার জল কিনে খেতে শুরু করেছেন।” কিন্তু যাদের ওই পানীয় জল কিনে খাওয়ার আর্থিক সঙ্গতি নেই। তাঁরা কী করবেন? ৪ নম্বরে ওয়ার্ডের বাসিন্দা মনীশ মণ্ডল বলেন, “পানীয় জলের কষ্টে ভুগতে হচ্ছে। আমাদের ওয়ার্ডে যেমন পাঁচরাহা মোড়ের পর থেকে এসডিও কার্যালয়ের যাওয়ার পথে পুরসভার কোনও ট্যাপকলে জল পাওয়া যায় না। পুরসভায় অভিযোগ জানিয়েও কোনও ফল হয়নি।”
প্রতি দিন সকালে সাড়ে ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত, দুপুরে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এবং দুপুর সাড়ে ৩টে থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ট্যাপকলে জল সরবরাহ হয়। কিন্তু দেখা গিয়েছে, জলের লম্বা লাইন। কিন্তু সময়ের আগেই আচমকা জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় বলেও অভিযোগ।
তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি তথা পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মহম্মদ আলির অভিযোগ, “পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে জলপ্রকল্প তৈরি হওয়ায় ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দারা পরিস্রুত পানীয় জল পেলেও পুর-এলাকার বাকি অংশে ওই জল সরবরাহ হয় না। শহরের বাকি অংশের মানুষ দু’বেলা সাইকেল-ভ্যান রিকশায় করে বোতলে ও জেরিকেন ভর্তি করে জল সংগ্রহ করে নিয়ে যান। এতে পুরসভার উদাসীনতায় দায়ি।”
এমনিতেই প্রাচীন মুর্শিদাবাদ শহরে পানীয় জলের সমস্যা দীর্ঘ দিনের। প্রতি বছরই তীব্র গরমে জলকষ্টে ভুগতে হয় পুরবাসীদের। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোথাও বালতির লম্বা লাইন। কোথাও বা সাত-সকালে কলপাড়ে চিল-চিৎকারে কান পাতা দায়। কোথাও হাতাহাতিও হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগকোথাও পাইপ লাইন থাকলে ট্যাপকল নেই। পাইপ লাইন বা ট্যাপকল থাকলেও সরু ফিতের মতো জল পড়ছে। কোথাও শুধু নলকূপ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে তা অকেজো। সারানোর কোনও উদ্যোগ নেই। কোথাও জলের পাইপ লাইন ফাটা। কলের মুখ দিয়ে না পড়ে ফাটা পাইপ দিয়েই জল গড়াচ্ছে। কোনও কোনও ওয়ার্ডে ট্যাপকলের মুখই নেই। ট্যাপকলের নল দিয়েই অনবরত জল পড়ে অপচয় হচ্ছে।
ওই সব দেখে শুনে মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন পুরপ্রধান ফরওয়ার্ড ব্লকের সুরজিৎ বসাক বলেন, “পরিশুদ্ধ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন শহরের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিশেষ করে পুরসভার পূর্ব দিক লাগোয়া ৭, ১১, ১৬ ওয়ার্ডের নম্বরের মানুষ পানীয় জল থেকে বঞ্চিত। পুরসভার নলকূপ রয়েছে। কিন্তু মাটির কোন স্তরে পাইপ লাইন বসানো হয়েছে, তা জানা নেই। ফলে টিউভওয়েলের জল পান করা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বস্তিবাসী থেকে পুরবাসীদের একাংশ ওই জল পান করতে বাধ্য হচ্ছেন।”
পুরসভা এলাকায় জল সরবরাহের জন্য জলের ট্যাঙ্কটি ৯ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে। তবুও ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জলকষ্টে ভুগতে হচ্ছে। পুরসভার বসতিপূর্ণ এলাকা কমলবাগে পুরসভার জল পাওয়া যায় না বললেই চলে। পণ্ডিতবাগ, কুর্মীতলা, মতিঝিল, হরিবাগ, দুবুয়াপাড়া, নসিপুর এলাকায় জলের টান দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
এই অবস্থায় গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ‘জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়্যাল মিশন’-এর আওতায় বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ করার কেন্দ্রীয় সরকারের ওই প্রকল্পের ঘটা করে উদ্বোধনও হয়। এতে মুর্শিদাবাদের পুরবাসিন্দারা কোথাও আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে ওই প্রকল্পের কাজ থমকে রয়েছে। ফলে পুর-নাগরিকদের পানীয় জল সমস্যা কোথাও রয়েই গেল! পুর-কর্তৃপক্ষও নাগরিকদের কোনও আশার বাণী শোনাতে পারেনি।
পানীয় জল সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে পুরসভার কাউন্সিলর বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, “‘জওহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়্যাল মিশন’-এর আওতায় বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহের জন্য কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক ৩৪ কোটি টাকার অর্থ অনুমোদনও দেয়। সেই মতো গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের উদ্বোধনও হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় জলের ট্যাঙ্ক নির্মাণের জন্য মাটি পরীক্ষার কাজও হয়েছিল। এমনকী অর্থ বরাদ্দের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বদল হওয়ায় ওই প্রকল্পের নাম পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে বলে আপাতত অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি থমকে রয়েছে।”
বিপ্লববাবু বলেন, “জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের ট্যাপকলের সংখ্যা রয়েছে ১১০টি। সেই মতো জলাধারও নির্মিত হয়। কিন্তু গত ৩০ বছরে এলাকায় জনসংখ্যা বেড়েছে। ফলে মানুষের চাহিদার কথা ভেবে জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতরের অনুমোদন ছাড়াই অতিরিক্ত ৫০০ জলের লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই একটি মাত্র জলাধার থেকেই জল সরবরাহ করার ফলেই জল সঙ্কট তৈরি হয়েছে।”