Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ঝড়ে নৌকো উল্টে মাঝি-সহ মৃত তিন

উত্তর আকাশে নিকশ কালো মেঘটার দিকে তাকিয়ে নৌকাটা ছাড়তে চাইছিলেন না বৃদ্ধ মাঝি। দীর্ঘ ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ চোখ বলছিল, ‘আকাশের অবস্থা কিন্তু ভাল নয়।’ জটার মতো মেঘটা যে কোনও মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো করে দিতে পারে! কিছু যাত্রী যে নাছোড়। বাড়ি যাওয়ার তাড়া রয়েছে তাঁদের। অগত্যা জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েছিলেন নৌকা ভাসাতে। সত্যিই কয়েক মুহূর্ত—সত্যি হল মাঝির আশঙ্কা। দমকা ঝড়ে মাঝ নদীতে উল্টে গেল নৌকো। তলিয়ে গেলেন যাত্রীরা।

জলঙ্গিতে চলছে উদ্ধার কাজ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

জলঙ্গিতে চলছে উদ্ধার কাজ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
চাপড়া শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০১:৫২
Share: Save:

উত্তর আকাশে নিকশ কালো মেঘটার দিকে তাকিয়ে নৌকাটা ছাড়তে চাইছিলেন না বৃদ্ধ মাঝি। দীর্ঘ ৩৫ বছরের অভিজ্ঞ চোখ বলছিল, ‘আকাশের অবস্থা কিন্তু ভাল নয়।’ জটার মতো মেঘটা যে কোনও মুহূর্তে সব কিছু এলোমেলো করে দিতে পারে! কিছু যাত্রী যে নাছোড়। বাড়ি যাওয়ার তাড়া রয়েছে তাঁদের। অগত্যা জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েছিলেন নৌকা ভাসাতে। সত্যিই কয়েক মুহূর্ত—সত্যি হল মাঝির আশঙ্কা। দমকা ঝড়ে মাঝ নদীতে উল্টে গেল নৌকো। তলিয়ে গেলেন যাত্রীরা। কেউ সাঁতরে ডাঙায় উঠলেন। কাউকে টেনে-হিঁচড়ে তোলা হল। উঠলেন না সেই বৃদ্ধ মাঝি। পর দিন, রবিবার সকালে ভেসে উঠল নিথর দেহ।

এ দিন ভোরে চাপড়া থানার তিলকপুর ঘাটের কাছে শ্যাওলার ভিতর থেকে টেনে তোলা হয় তিলকপুরে বাসিন্দা ভজহরি বিশ্বাসকে (৬২)। প্রায় ৩৫ বছর ধরে তিনি তিলকপুর ও ধুবুলিয়া থানার দেবীপুরের মাঝে জলঙ্গী নদীতে খেয়া পারাপার করে আসছেন।‌ নৌকো ডুবিতে মৃত্যু হয়েছে তিলকপুরেই বাসিন্দা প্রদীপ ঘোষ (৪২) ও নদীর পাশেই এক ইটভাটার শ্রমিক‌ উত্তরপ্রদেশের সুলতানগঞ্জের বাসিন্দা চন্দ্রপাল বর্মার (৩৫)।

কিন্তু, এমন অভিজ্ঞ মাঝির জলে ডুবে মৃত্যু হল কী করে?

পুলিশের অনুমান, ভজহরিবাবু সাঁতরে ঘাটের কাছে এলেও জলে ভেসে থাকা শ্যাওলায় আটকে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। চন্দ্রপ্রসাদ সাঁতার জানত না। সম্ভবত, সে প্রদীপকে বাঁচার জন্য জড়িয়ে ধরায় দু’জনই ডুবে যায়। তাঁদের দু’জনের দেহ মাঝ নদী থেকে পাশাপাশি উদ্ধার হয়েছে। তবে ছাড়ার সময়ে নৌকোয় কত জন যাত্রী ছিল তা নিয়ে রবিবার পর্যন্ত ধোঁয়াশা কাটেনি। প্রশাসন সূত্রে খবর, অন্তত কুড়ি জন যাত্রী ছিলেন ওই নৌকোয়।

এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে বাড়ি ফিরছিলেন কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণির বাসিন্দা স্কুল শিক্ষক রঞ্জিত ঘোষ। স্ত্রী, ভাই, ভাই-বৌ এর সঙ্গে বছর পাঁচেকের ভাইপোও ছিল। কোনও রকমে বেঁচেছেন তারা। এ দিন সকালে জল থেকে উদ্ধার হওয়া মোটর বাইক নিতে এসেছিলেন তিনি। নদীর পাড়ে শুইয়ে রাখা মাঝি ভজহরির দেহের দিকে চেয়ে ডুকরে উঠলেন তিনি। বলেলন,‘‘উনি কিছুতেই নৌকা ছাড়তে চাইছিলেন না। বারবার বলছিলেন আকাশের অবস্থা ভাল না। তার কথা শুনতে চাইছিলেন না অনেকেই। বিশেষ করে যাঁদের সঙ্গে মোটর বাইক ছিল। বৃষ্টিতে রাস্তায় কাদা হয় বলে তাঁরা আগেই নদী পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠতে চাইছিলেন। তাঁদের চাপেই নৌকা ছাড়তে বাধ্য হন মাঝি।’’

নৌকোর প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীরা জানালেন, আকাশে তখন প্রচণ্ড মেঘে কালো হয়ে এসেছে। নৌকা মাঝ নদীতে। নদীর এ পার থেকে ও পার মোটা নাইলনের দড়ি বাঁধা। সেই দড়ি ধরে ধরে নৌকা তিলকপুরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভজহরিবাবু। আচমকা ঝড়। এক যাত্রীর কথায়, ‘‘নৌকো একবার কাত হলেও উল্টে গেল না। কোনও রকমে সামলে ওঠার আগেই ফের ঝড় আছড়ে পড়ল নৌকোর উপরে। এ বার আর কিছুই করার থাকল না! মাঝির হাত থেকে ছিটকে গেল দড়ি। মাঝ নদীতে উল্টে গেল নৌকা।’’ রঞ্জিতবাবু বলেন, ‘‘চার দিকে নিকষ অন্ধকার। পায়ে চামরার বুট। জলের ভিতরেই কোনও মতে ভারি বুট খোলার চেষ্টা করলাম। উল্টে দড়িতে গিট পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কপাল ঠুকে অন্ধকারে পাড়ের দিকে এগিয়ে চললাম। শেষ পর্যন্ত কে যেন জল থেকে তুলে নিল।’’ একই অভিজ্ঞতা বৃদ্ধ গোবিন্দ ঘোষের।

চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে স্থানীয়েরা প্রথমে উদ্ধার কাজে হাত লাগান। পরে আসে সিভিল ডিফেন্সের লোকজন। আসে ডুবুরিও। তবে অক্সিজেন সিলিন্ডার না থাকায় জলে নামতে পারেননি তিনি। তবে দুই পাড়ের কয়েক’শো মানুষ গভীর রাত পর্যন্ত নিজেদের মতো করে তল্লাশি চালিয়ে গিয়েছেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভোর বেলায় ফের তল্লাশি শুরু হতেই একে একে তিন জনের দেহ উদ্ধার হয়।

এ দিন ঘটনাস্থলে আসেন কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাসক মৈত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায় ও অতিরিক্ত জেলাশাসক অভিজিৎ ভট্টাচার্য। তাঁরা মৃতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE