Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

হাজারি চাঁদার হাজার জুলুম

যাত্রী নামিয়ে দু’পা এগোতেই ফের সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল বাসটা। লাঠিসোটা হাতে একেবারে বাসের সামনে ছেলেগুলো। কোনও কথা নেই, সটান রসিদটা উঁচিয়ে ধরল তারা। নড়বড়ে হাতের লেখায় স্পষ্ট টাকার অঙ্কটা।

হাঁসখালি থেকে বগুলা যাওয়ার রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র

হাঁসখালি থেকে বগুলা যাওয়ার রাস্তায়। — নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
কৃষ্ণনগর ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০২:২৮
Share: Save:

যাত্রী নামিয়ে দু’পা এগোতেই ফের সজোরে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল বাসটা। লাঠিসোটা হাতে একেবারে বাসের সামনে ছেলেগুলো। কোনও কথা নেই, সটান রসিদটা উঁচিয়ে ধরল তারা। নড়বড়ে হাতের লেখায় স্পষ্ট টাকার অঙ্কটা।

—‘‘একেবারে ১০০০!’’ অস্ফূটে বলেই ফেললেন চালক। ‘‘এ তো হাতের ময়লা... মানে মানে দিয়ে দে,’’ বলেই তাড়া দিল দলের নেতা।

জাতীয় সড়ক থেকে অলি-গলি, বাস চালক থেকে লরি চালক, অটো কিংবা টোটো, চাঁদার জুলুম সর্বত্র। এমনকী ছাড় পাচ্ছেন না মোটরবাইক আরোহীও। দেখতেও পাচ্ছে সবাই, শুধু দেখতে পাচ্ছে না পুলিশ। উল্টে আইএনটিইউসি অনুমোদিত লরি শ্রমিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লিয়াকত আলির অভিযোগ, পুলিশই তুলে নিয়ে গিয়ে এক-দু’শো টাকা চাঁদা তুলছে। কারণ কমবেশি প্রত্যেক থানাতেই তো কালীপুজো হয়। যদিও এ অভিযোগ মানতে নারাজ পুলিশ।

বাস ও লরি মালিক সমিতির সদস্যরা কিন্তু বলছেন দুর্গাপুজোর থেকেও ভয়াবহ অবস্থা কালীপুজোয়। মানছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। স্বাভাবিক! একের পর এক অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে দেয়।

ঘটনা ১: তখনও ঘুম ভাঙেনি শহরের। ভোরের আলো ফোটার আগেই আড়মোড়া ভেঙে জনা কয়েক যুবক লাঠি-বাঁশ হাতে হাজির ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে চুঁয়াপুর মোড়ের কাছে। কলকাতাগামী অথবা উত্তরবঙ্গগামী পণ্যবাহী লরি আসতে দেখলেই রাস্তার মাঝে গিয়ে লাঠি-বাঁশ তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু।

ঘটনা ২: দুপুর শেষ হয়ে বিকেল গড়িয়েছে। তেহট্ট থানার পলাশীপাড়া রুদ্রনগর। বেতাই-পলাশীর রাজ্য সড়কের উপরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলছে চাঁদা আদায়। মাঝেমধ্যেই
উড়ে আসছে হুমকি। আচমকা টহল দিতে দিতে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় তেহট্ট থানার গাড়ি। ব্যস দে দৌড়। পিছু ধাওয়া করে দু’জনকে ধরে
ফেলে পুলিশ।

কৃষ্ণনগর থেকে রানাঘাট, শান্তিপুর থেকে কল্যাণী, চলছে চাঁদার জুলুম। রাস্তার উপরে বাস-লরি দাঁড় করিয়ে দিয়ে চালকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের বিল। রাজি না হলেই, হাড় হিম করা দৃষ্টি। সঙ্গে প্রচ্ছন্ন হুমকি। বাধ্য হয়েই টাকা মিটিয়ে দিচ্ছেন অনেকে।

নদিয়া বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে অসীম দত্ত বলেন, “অন্য বারের তুলনায় এ বছর যেন চাঁদার জুলুম অনেকটাই বেড়েছে। শুধু যে সংখ্যায় বেড়েছে, তা-ই নয় চাঁদার অঙ্কটাও বেড়েছে কয়েক গুণ। সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

তাঁদের অভিযোগ, এক দিকে কৃষ্ণনগর-রানাঘাট হয়ে বাদকুল্লা রাজ্য সড়কের উপরে জালালাখালি থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রাস্তায় বিশেষ করে বীরনগর, রাধানগর, তাহেরপুর, আইশতলা তো অন্য দিকে কৃষ্ণনগর-দত্তফুলিয়া রাজ্যসড়কের একাধিক জায়গা বিশেষ করে হাঁসখালি, বগুলার পাশাপাশি শান্তিপুরের রেলগেট, কাশ্যপপাড়া, ঘোড়ালিয়া, ফুলিয়াপাড়া-সহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার উপরে চলছে গাড়ি থামিয়ে চাঁদার জুলুম। আবার চাপড়া রুটের দৈয়েরবাজার, নাজিরপুর, মহিষবাথান, করিমপুরের বিভিন্ন এলাকা-সহ তেহট্টেও চলছে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চাঁদা আদায়।

কৃষ্ণনগর-মাজদিয়া রুট আবার চাকদহ থেকে নেতাজীবাজার, বনগ্রাম রাজ্য সড়ক এমনকী রানাঘাট শহররের মধ্যেও বেশ কয়েকটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তোলা হচ্ছে বসে অভিযোগ। কালীগঞ্জ বাজারের পাশাপাশি দেবগ্রামে জাতীয় সড়কের উপরে চাঁদা তুলতে দেখা গেল বৃহস্পতিবারও।

কালীপুজোর বেশ কিছু দিন আগে থেকেই ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে পঞ্চাননতলা রেলগেটের পশ্চিম পাড়ে বিষ্ণুপুর মোড় থেকে বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধানে তিন থেকে চার জায়গায় লরি থামিয়ে চাঁদা আদায় চলছে। এক দল বাঁশ-কাঠ হাতে লরির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে আর অন্য দলটি চাঁদার রসিদ হাতে সোজা চালকের জানলায়।

নদিয়া জেলা লরি মালিক সমিতির সম্পাদক জগদীশ ঘোষের কথায়, “জায়গায় জায়গায় লরি দাঁড় করিয়ে মোটা টাকা চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। রাজি না হলেই মার খেতে হয় চালক-খালাসিকে।” তিনি বলেন, “বিশেষ করে বগুলা রুটে ঢুকলে অন্তত দু’হাজার টাকা চাঁদা দিতেই হবে।”

এক অবস্থা টোটো চালকদেরও। এর আগে খোদ কৃষ্ণনগর শহরে চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল এক টোটো চালককে। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে ভর্তি করা হয় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে।
আবার চাঁদা দিতে না চাওয়ায় বগুলা রুটে মেরে মাথা ফাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক লরি চালকের। সে
বার ওই ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক তৃণমূলের সত্যজিৎ বিশ্বাসের ঘনিষ্টদের।

কী বলছেন পুজো কর্তারা?

বিষ্ণুপুর কালীবাড়ি মোড় পুজো কমিটির সদস্য সুভাষ দে-র কথায়, ‘‘পুজোর খরচ আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে লরি চালকদের কাছ থেকে চাঁদা না তুলে উপায় থাকে না।’’ তবে তাঁর বক্তব্য, চাঁদা যেমন তোলা হয়, তেমনই পুজোর ভোগও লরিচালক ও খালাসিদের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করা হয়।

মধুপুর বাজারের কাছে ‘ভাইভা সঙ্ঘ’ কালীপুজোর আয়োজন করে থাকেন। ওই পুজো কমিটির সদস্য মদনগোপাল দাস অবশ্য জোর করে চাঁদা তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা শুধু সদস্য ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে পুজো করি।’’

পুলিশ কোন ভূমিকায়?

বাসিন্দা কিংবা পথচলতি মানুষের অনেকেরই দাবি, চাঁদার জুলুমের সঙ্গে জড়িয়ে যে সব পুজোর নাম, তাদের অধিকাংশের পিছনে রয়েছে শাসক দলের কোনও না কোনও নেতার নাম। আর তাই পুলিশ দেখেও দেখে না। নদিয়া জেলার এসপি শীষরাম ঝাঁঝারিয়ার অবশ্য দাবি, গত এক সপ্তাহে অন্তত সাতটি মামলা দায়ের হয়েছে, ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অতএব পুলিশ চোখ বুজে বসে নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subscription kali puja
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE