কীর্তন পরিবেশন করছেন কলাবতী দেবী, পাশে সরস্বতী দাস। ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।
ফুলে ফুলে ভরা মঞ্চের এক দিকে চৈতন্য মহাপ্রভুর মৃন্ময় মূর্তি। অপর দিকে রাধাকৃষ্ণের ধাতব বিগ্রহ। সেই মঞ্চ থেকে ভেসে-আসা কীর্তনের সুরে ঘন হয়ে উঠছে আষাঢ়ের দুপুর।
কখনও মল্লারে বাঁধা মহাজন পদ গাইছেন কীর্তনরসভারতী সরস্বতী দাস, তো কখনও নবীন প্রজন্মের সুমন ভট্টাচার্য। আবার পরক্ষণেই মঞ্চে মণিপুরি ঘরানায় নৃত্য-সহযোগে কীর্তনশৈলী পরিবেশন করছেন গুরু কলাবতী দেবী। ঝাড়খণ্ডের কীর্তনে কীভাবে মিশেছে মার্গীয় ঝুমুরের সুর, শোনাচ্ছেন চিত্রলেখা দাসী। কখনও একঝাঁক মৃদঙ্গ নিয়ে শ্রীখোল লহরায় মঞ্চ মাতিয়ে দিচ্ছেন হরেকৃষ্ণ হালদার। শ্রোতাদের ভিড় মঞ্চের ছোট পরিসর উপচে হলের বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। একই রকম মন দিয়ে তাঁরা শুনছেন কীর্তন বিষয়ে আলোচনা।
কৃষ্ণনগরের দ্বিজেন্দ্রমঞ্চে শনি এবং রবিবার দু’দিনের কীর্তন সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন শহরের পরিচিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নটরাজ কলাসঙ্গম। নদিয়ার জেলাসদরে এই প্রথম হল কীর্তন সম্মেলন। দ্বিজেন্দ্রমঞ্চ সংলগ্ন স্থান সাজানো হয়েছিল বাংলার কীর্তন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের মন্তব্য দিয়ে। নজর টানছিল বড় বড় ফ্লেক্সে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল বা অতুলপ্রসাদ সেন রচিত কীর্তনাঙ্গের গানের তালিকা। সব মিলিয়ে কীর্তনকে নিয়ে অন্যরকম চর্চা। কেন এই উদ্যোগ ? নটরাজ কলা সঙ্গমের সম্পাদক বাসুদেব মণ্ডল জানান, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যেদেবের অত্যন্ত প্রিয় ছিল কীর্তন। তাঁর সময়ে তিনিই কীর্তনের ব্যাপক প্রচার করেছিলেন। আবার রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত জগতের বহু বিশিষ্ট জন কীর্তনকেই বাংলার আদি ও নিজস্ব সঙ্গীত ধারা বলে মেনেছেন। কিন্তু কীর্তনের চর্চা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন কীর্তন বলতে অনেকেই বোঝেন কেবল নাম সংকীর্তন। কিন্তু কীর্তনের ভান্ডার যে কত সমৃদ্ধ, কত বৈচিত্রময় হতে পারে, শ্রোতাদের কাছে তা তুলে ধরার জন্য এই আয়োজন।
বাসুদেববাবু বলেন, “নবদ্বীপ কীর্তনের পীঠস্থান। সংলগ্ন কৃষ্ণনগর বাংলার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নাম। কীর্তনকে তার পূর্ণ গরিমায় ফের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কৃষ্ণনগরের ভুমিকা থাকা প্রয়োজন। তাই সম্মেলনের আয়োজন।’’ প্রবীণ কীর্তনিয়া সরস্বতী দাস বলেন, “প্রতিদিন সকাল দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত মানুষ বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনেছেন। এতেই বোঝা যায়, শোনাতে পারলে মানুষ কীর্তনও শুনবেন।”
রবিবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে। কলাবতী দেবী ব্যাখ্যা করছিলেন, মণিপুরের কীর্তনের সঙ্গে কীভাবে মিশেছে নৃত্য। কোথায় বাংলার কীর্তন থেকে মণিপুরের কীর্তন স্বতন্ত্র। এক সময়ে কথা হারিয়ে যায়। বেজে ওঠে মণিপুরি কীর্তনের অনুষঙ্গ। কলাবতী দেবী গেয়ে ওঠেন “এসো হে গৌর...”
কীর্তনে বুঁদ একদল মানুষের চোখের জল মিশে যায় আষাঢ়ের বৃষ্টিধারার সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy