Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
স্রোতের বাইরে (পরিচারিকা)

বানভাসি কপালে পাকা ছাদ জুটল কই

দরজায় ঝাঁপ টেনে ওঁরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়নন, তখন ক্রমে ফর্সা হয় পুবের আকাশ। প্রফুল্লনগর থেকে নবদ্বীপ তেঘরিপাড়া কিংবা দেয়ারাপাড়া নেহাত কম দূর নয়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৪৯
Share: Save:

দরজায় ঝাঁপ টেনে ওঁরা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়নন, তখন ক্রমে ফর্সা হয় পুবের আকাশ। প্রফুল্লনগর থেকে নবদ্বীপ তেঘরিপাড়া কিংবা দেয়ারাপাড়া নেহাত কম দূর নয়। কমবেশি ৩ কিলোমিটার তো বটেই। ওদের কেউ আসেন আরও দূরের চর গদখালির ঘোষপাড়া থেকে। পরনে রঙচটা ছাপা শাড়ি। হাজা পায়ে প্লাস্টিকের চপ্পল। চোখে তখনও নাছোড় ঘুম। কালীর মা, মালতির মা, লক্ষ্মীর মা এই সব নামেই ওঁদের চেনে শহর। যদিও ভোটের খাতায় ওঁদের কারও নাম দুলালি বিশ্বাস, মিনতি হালদার, সান্ত্বনা বৈরাগী। শহরের বাড়ি বাড়ি ‘ঝি’-এর কাজ করে দিন গুজরান করেন ওঁরা।

পরিচারিকাদের সঙ্গে বাড়ির মালকিনদের সম্পর্কটা ভারী অদ্ভুত। উভয়েই উভয়কে ‘আড় চোখে দেখে’। যাঁদের ছাড়া এক পা-ও চলে না সেই কাজের লোকদের নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই প্রতি বাড়িতে। ফাঁকিবাজ, ছুতো পেলেই কামাই— অভিযোগের তালিকা ক্রমে লম্বা হয়। এমনকি, বাড়ির কিছু খোয়া গেলে সবার আগে ওঁদের দিকেই সন্দেহের আঙুল ওঠে।

এই ভোটে পাল্টা আঙুল তুলছেন ওঁরা। কারও জোটেনি রেশনের চাল-গম। কেউ পাননি সরকারি আবাস। একটু বয়স্কদের অবস্থা আরও করুণ। কাজ করার মতো ধকল সইতে না পারলে পোড়মাতলা, গঙ্গার ঘাট কিংবা কোনও মন্দিরের সামনে ঠাঁই হয় ওদের। সামনে পাতা তোবড়ানো বাটি। তবুও জোটে না বার্ধক্য বা বিধবা ভাতা।

নবদ্বীপ শহরের দক্ষিণ অংশের পরিচারিকারা আসেন লাগোয়া মহিশুরা পঞ্চায়েত এবং পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রফুল্লনগর বা ২০ নম্বর ওয়ার্ডের রেললাইনের ধারের ঝুপড়ি থেকে। আবার শহরের পশ্চিম বা মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ ঠিকে কাজের লোক আসেন ১ নম্বর ওয়ার্ডের চন্দ্র কলোনি, গুমটি বা বর্ধমানের দোলগোবিন্দপুর থেকে। সকালে উঠে শহরে চলে আসা দিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে দুপুর ২টো বা আড়াইটে। ফের বিকেলে ৪টে বাজতে না বাজতে বিকেলের কাজ করতে বেরিয়ে পড়া।

বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট স্টেশনের কাছে এক ঝুপড়িতে থাকেন মালতির মা। তিনি বলেন, “শুনেছি এখন নানা রকম কার্ডে অনেক কিছু দেয় সরকার। কই আমরা তো সে সব পাই না। সপ্তাহে মাথা পিছু ৫০০ গ্রাম করে চাল আর আটার প্যাকেট পাই।” কেন দু’টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল পান না? প্রশ্ন শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। বলেন, “পেলে কি মিথ্যা বলব? পাই না বলেই তো বলছি, কারা পান?” মালঞ্চ পাড়ায় থাকেন লক্ষ্মীর মা। তিনি অবশ্য ২ টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল পান। কিন্তু তাঁর অভিযোগ মারাত্মক। বলেন, “মাঝে মাঝে এমন চাল দেয়, খাওয়া যায় না। রান্না করলে গন্ধে পেটের ভাত উঠে আসে। তাই এখন সব সময় চাল নিই না। পোকাধরা চাল কিনে নষ্ট করার মতো পয়সা কি আমাদের আছে?”

প্রফুল্লনগরে থাকেন দুলালি। স্বামীর পৈত্রিক এক কাঠার সামান্য বেশি জমি আছে। বহুদিন জমির দলিল,পরচা নিয়ে ঘুরেছেন। এই আশায় যদি সরকারি বাড়ি হয়। তিনি বলেন, “গঙ্গার কোলে থাকি। বানভাসি হয়ে শিবিরে আশ্রয় নেওয়া যেন আমাদের কপালের লেখা। ভেবেছিলাম মাথার উপর পাকা ছাদ হলে, সেই দুঃখ ঘুচবে। হল কই?”

এমন অপূর্ণ ইচ্ছা নিয়ে রোজ সকালে বেরিয়ে পড়েন অন্যের বাড়ি সাফ করতে।

ভোট দেবেন তো? জবাবে খানিক চুপ থেকে বলে ওঠেন, ‘‘দেব তো বটেই...”।

কথাটা শেষ করেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flood Victim Lok Sabha Election 2019 Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE