Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

যুগল হোক বা কিশোরী অন্ন, খিচুড়ি বিনে বেজার বর্ষা

মুর্শিদাবাদে একটি চালু শব্দ হল ‘গাজল’। বর্ষায় তিন থেকে সাত দিন নাগাড়ে বৃষ্টি হলে তাকে গাজলের দিন বলেন বেশ কিছু এলাকার মানুষ। ঝমঝমিয়ে হোক বা ইলশেগুড়ি— গাজল মানেই মুর্শিদাবাদে শুরু খিচুড়ি পরব।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনল আবেদিন
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৮ ০০:৪৯
Share: Save:

রিমঝিম বৃষ্টির দিন তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আষাঢ়-গগনে বর্ষার মেঘ জমলেই তার মরসুম শুরু। কেউ বলেন, ‘কিশোরী অন্ন’। কেউ ডাকেন, ‘যুগল’। শুকনো লঙ্কা, ফোড়নে ঝালঝাল স্বাদে তার নাম আবার ‘জগাইমাধাই’। তবে নামে আর কী আসে-যায়! আসলে তো সেই চেনা চালেডালের অমৃত। ফলে বর্ষা নামলেই বাঙালির খিচুড়ি বিনে গীত নেই। সঙ্গে ইলিশ হলে একেবারে রাজযোটক। নিতান্তই না হলে ডিমভাজা, নিদেনপক্ষে পাঁপড়। বাদলদিনে গ্রামের রসুইঘর থেকে শহরের ওপেন কিচেন বাঁধা পড়ে যায় খিচুড়িতে।

মুর্শিদাবাদে একটি চালু শব্দ হল ‘গাজল’। বর্ষায় তিন থেকে সাত দিন নাগাড়ে বৃষ্টি হলে তাকে গাজলের দিন বলেন বেশ কিছু এলাকার মানুষ। ঝমঝমিয়ে হোক বা ইলশেগুড়ি— গাজল মানেই মুর্শিদাবাদে শুরু খিচুড়ি পরব। আষাঢ়-শ্রাবণে গাজল লাগলেই চালেডালের চেনা সিগনেচার টিউন। এই ট্র্যাডিশান আজও চলছে। তবে দিনবদলের সঙ্গে খিচুড়ির বিবর্তনও নেহাত কম ঘটেনি। গাজলে আগে যেমন খেতমজুর থেকে গৃহস্থবাড়িতে খিচুড়ি অবধারিত ছিল। এখন বর্ষা নামলেই বহরমপুরের অভিজাত তারকা হোটেলের মেনুতেও অনায়াসে জায়গা করে নেয় খিচুড়ি।

তবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে খিচুড়ির রকমফের আছে। বর্ষার ইলিশ-খিচুড়ির সঙ্গে মোটেই মিলবে না শীতের রাতে ঘি চপচপে ফুলকপির খিচুড়ি। কিংবা পাঁচ-সাত হাজার লোকের ‘মোচ্ছবে’ পাঁচ আনাজের ল্যাবড়া খিচুড়ির সঙ্গে কাজু কিসমিস দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি ভুনা বা ভুনি খিচুড়ির আকাশপাতাল ফারাক। আবার আধাআধি পরিমাণ সোনামুগ ডাল ও সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চালের ঘি-গরমমশলা দেওয়া খিচুড়ি থেকে যোজন খানেক দূরে অবস্থান করে মুসুরডাল এবং তুলসীভোগ চালের ভাজা পেঁয়াজের খিচুড়ি।

আবার ঠাকুরবাড়ির ভোগের খিচুড়ির স্বাদই আলাদা। আশ্চর্য একটা গন্ধ আছে সেই খিচুড়ির। কোনও এক বৃষ্টিভেজা ভিক্ষাহীন সকালে স্নান-আহ্নিক সেরে নিরুপায় বৈষ্ণব কিংবা বোষ্টমী ভাঁড়ারের যৎসামান্য সঞ্চয় জড়ো করে চাপিয়ে দেন ‘যুগল’। তার পরে আপন মনে কীর্তনের সুর ভাঁজেন আর পরম যত্নে রাঁধেন পাঁচমিশালি চাল-ডালের খিচুড়ি। গৃহস্থ বাড়িতে হাজার চেষ্টা করেও খিচুড়ির অমন অলৌকিক স্বাদ হয় না।

নবদ্বীপ মহাপ্রভু মন্দিরে খিচুড়ি ‘কিশোরী অন্ন’ নামে পরিচিত। প্রবীণ সেবায়েত লক্ষীনারায়ন গোস্বামীর কথায়, ‘‘কিশোরী অন্ন মহাপ্রভু মন্দিরের শীতকালীন ভোগের বাধ্যতামূলক পদ। সোনামুগের কাঁচা ডাল ঘি দিয়ে ভাল করে মেখে লাল করে ভেজে নিতে হবে। পিতলের হাঁড়িতে ফুটন্ত গরম জলে সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চাল এবং ওই ভেজে রাখা ডাল সুসিদ্ধ করে নিতে হবে। পৃথক ভাবে ভাজতে হবে ডুমো ডুমো করে কাটা নতুন আলু ও ফুলকপি। ভাজা আলু, কপি ও মটরশুঁটি ছেড়ে দিতে হবে সিদ্ধ করে রাখা চাল ও ডালের মধ্যে। এ বার মিশবে নানা রকমের মশলা। আদা জিরে লঙ্কা বাটা সঙ্গে পরিমাণ মতো নুন, হলুদ, মিষ্টি। পাক সম্পূর্ণ হওয়ার পরে আলাদা পাত্রে ওই কিশোরী অন্ন রেখে দেওয়া হয়। শেষে শুকনো লঙ্কা, জিরে, তেজপাতা লাল করে ঘিয়ে ভেজে সম্বার দেওয়া হয়। নামানোর আগে পর্যাপ্ত পরিমাণে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঘরের তৈরি গাওয়া ঘি। গোটা শীতকাল জুড়েই এই কিশোরী অন্ন মহাপ্রভুর ভোগে প্রধান পদ হিসাবে পরিবেশিত হয়।’’

মন্দিরের ভোগে পরিবেশিত হয় ভুনা বা ভুনি নামের ভিন্ন ধরনের খিচুড়ি। সোনামুগের ডাল আর সুগন্ধী গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে কিসমিস, কাজু এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে মিষ্টি দিয়ে তৈরি ঘি চপচপে ওই খিচুড়িকে অনেকে মিষ্টি খিচুড়িও বলেন। এই খিচুড়ি ঝরঝরে, অনেকটা পোলাওয়ের মতো। ঘন বর্ষার দিনে আলু, কপি, পাঁপড়ের মতো মুখরোচক ভাজার সঙ্গে এই খিচুড়ি ভোগ দেওয়া হয় বলদেব মন্দির, মদনমোহন মন্দির বা সমাজবাড়িতে। কোথাও নিবেদনের সময় চুড়ো করা খিচুরির মাথায় ছোট ছোট বাটিতে দেওয়া হয় সর তোলা বিশুদ্ধ ঘি।

ইসলামপুর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক দীপক বিশ্বাসের আদি বাড়ি নওদার সব্দরনগর। বেশ কয়েক দশক ধরে তিনি বহরমপুরের বসিন্দা। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলছেন, “গাজলের দিনে সব্দরনগর-সহ গ্রামের ঘরে ঘরে পাঁচ খিচুড়ি, ঝোলা খিচুড়ি ও ভোনা খিচুড়ির কদর ছিল যথেষ্ট। সেই কদর এত বছর পরেও কী গ্রামে, কী শহরে বেড়েছে বই কমেনি।” বহরমপুরের এক অভিজাত হোটেলের শেফ শেখ সাবির বলেন, ‘‘বর্ষার সময় খিচুড়ির চাহিদা বাড়ছে। ক্রেতারা আগাম জানালেই তাঁদের চাহিদা মতো খিচুড়ি রান্না করে পরিবেশন করা হয়। সঙ্গে ইলিশ-সহ নানা রকমের মাছভাজা কিংবা ডিমের ওমলেট ও আলুর দম। ভেজ, চিকেন, মটন সব রকমের খিচুড়ি মেলে।” বহরমপুর শিল্পতালুকের এক হোটেলের শেফ কামরুজ্জামান মোল্লা রোহিদ বলেন, “মাছ ভাজা ছাড়াও বেগুন ভাজা, আলু ভাজা ও পটল ভাজা খিচুড়ির জনপ্রিয় অনুষঙ্গ। আগাম অর্ডার দিলে সেই মতো খিচুড়ি রান্না হয়। পদ অনুসারে ১২৫ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা থালি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Food Monsoon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE