Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ইলিশের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন শাশুড়িরা

খুকখুক কাশি দিয়ে দাওয়ায় উঠলেন সনাতন। আর, হেঁশেল থেকে বেরিয়ে বউ ঝাঁঝিয়ে উঠল—‘আবার ইলিশ! রোজ ইলিশ! বলি, শাক-সব্জি কি সব বানের জলে ভেসে গিয়েছে!’’

দেড়-সেরি: জামাইষষ্ঠীর বাজার।

দেড়-সেরি: জামাইষষ্ঠীর বাজার।

গৌরব বিশ্বাস ও দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৭ ১২:৪৮
Share: Save:

পদ্মা থেকে সনাতন মণ্ডল বাড়ি ফিরছেন। হাতে দেড় সেরি একটা ইলিশ।

অথচ সনাতনের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে, যেন বড্ড অপরাধ করে ফেলেছেন।

তা করেছেন বইকী! পদ্মাপারের লোক ছাড়া সে আর কেউ বুঝবে না।

খুকখুক কাশি দিয়ে দাওয়ায় উঠলেন সনাতন। আর, হেঁশেল থেকে বেরিয়ে বউ ঝাঁঝিয়ে উঠল—‘আবার ইলিশ! রোজ ইলিশ! বলি, শাক-সব্জি কি সব বানের জলে ভেসে গিয়েছে!’’

সনাতন কথা না বাড়িয়ে দরমার বেড়া ঠেলে ফের পথে বেরোন। এক সব্জি বিক্রেতাকে বহু অনুরোধ করে সেই ইলিশ দিয়ে একটা লাউ চেয়ে নেন। কুচো চিংড়ি বাড়িতেই ছিল। কর্তার হাতে কচি লাউ দেখে গিন্নিও খুশি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, বছর কুড়ি-বাইশ আগে পদ্মা ঘেঁষা রাজাপুর, রানিনগর, সাগরপাড়া, জলঙ্গি কিংবা কাছারিপাড়ায় ইলিশের এমনই রমরমা ছিল। রোজ রোজ ইলিশ খেতে খেতে হাঁফিয়ে উঠতেন অনেকে। স্বাদ বদলাতে মাঝে মধ্যেই একটা কুমড়ো, লাউ কিংবা এক জোড়া নারকেলের বিনিময়ে দিয়ে দেওয়া হতো এক-দেড় সের ওজনের ইলিশ।

আর এখন? সে পদ্মাও আর আগের মতো নেই, দেখা নেই ইলিশেরও। অবস্থা এমনই যে, পদ্মাপারের জামাইষষ্ঠীতে বাবাজীবনেরা কব্জি ডুবিয়ে খেলেন ঠিকই। কিন্তু শাশুড়িদের আক্ষেপ, পদ্মার ইলিশ বিনে কি আর ষষ্ঠী জমে!

করিমপুরের নন্দরানি মণ্ডল যেমন বলছেন, ‘‘এ কী দিন এল বলুন তো? বাড়ির কাছে পদ্মা আছে। অথচ ইলিশ নেই। মেয়ে-জামাইয়ের পাতে এক টুকরো ইলিশ দিতে পারছি না। কী লজ্জা!’’ সাগরপাড়ার সীমা প্রামাণিক বলছেন, ‘‘পদ্মার তো ইলিশ এখন মিলছেই না। আবার বাইরে থেকে যা ইলিশ এসেছে তা কেনার সাধ্য আমাদের নেই। অগত্যা পোলট্রি। কিন্তু পদ্মার ইলিশ আর পোলট্রি কি এক হল?’’

বাঙালির ইলিশ প্রীতি প্রাচীন কালের। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এর আদি পর্বে নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘মনে হয়, আজিকার দিনের মতো প্রাচীন কালেও ইলিশ মাছ বাঙ্গালীর অন্যতম প্রিয় খাদ্য ছিল এবং ইলিশ তৈল নানা প্রয়োজনে ব্যবহার হইত।’ আদি মধ্যযুগে ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ থেকে প্রমাণ মিলেছে বাঙালির প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার শীর্ষে থাকত মাছ। ঋতুভেদে আহার্য মাছ যেত বদলে। সেই হিসেবে জামাইষষ্ঠী হল ইলিশ খাওয়ার উপযুক্ত সময়।

ইলিশ নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন কান্দির জেমো এন এম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা ‘ফিসারমেন অফ দ্য কোস্টাল ডিস্ট্রিক্ট অফ বেঙ্গল’ গ্রন্থের লেখক সূর্যেন্দু দে। তিনি জানান, একটা সময়ে ইলিশ মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বিধি নিষেধ মেনে চলা হত। যেমন, বাঙালিরা বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে বিজয়া দশমী থেকে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত কেউ ইলিশ খেতেন না। আবার কার্তিক এবং বৈশাখ মাসেও বহু এলাকায় ইলিশ খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এখন কেন্দ্র সরকারও মাছ ধরার সময় ঠিক করে দিয়েছে। মাঝের সেই সময়ে ইলিশ শুধু পুষ্টই হয় না, অসম্ভব স্বাদুও হয়ে ওঠে। ফলে জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাইষষ্ঠীর সময়ে ইলিশের যে ছড়াছড়ি হবে, সেটাই স্বাভবিক।

কিন্তু রসনার লোভে যে দিন থেকে নিয়ম ভাঙা শুরু হয়েছে সে দিন থেকেই পাতে ইলিশ হারাতে শুরু করেছে বাঙালি। নিট ফল, বুধবার সকালে কান্দি বাজারে বারোশো গ্রাম ওজনের ইলিশ দেড় হাজার কেজি দরে ভাগাভাগি করে কিনতে হয়েছে মুকুল সেন এবং বিমান দাশকে। ষষ্ঠীর আগের দিন মুর্শিদাবাদের গঙ্গায় ধরা একটি ইলিশ বহরমপুর বাজারে বিক্রি হয়েছে ২৩০০ টাকায়। জামাইষষ্ঠীতে নবদ্বীপ বাজারে ঘুরপথে আসা বাংলাদেশের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৮০০-২০০০ টাকার মধ্যে। কিন্তু সে মাছ কেনার সাধ্য আছে ক’জনের!

সূর্যেন্দুবাবু বলছেন, ‘‘ইলিশের প্রজননের শর্তগুলো অবহেলা করা হচ্ছে। প্রজনন ক্ষেত্রই তো হারিয়ে যাচ্ছে। মাছ ধরার সময়সীমা কেউ মানে না। ফলে এখন ইলিশ নিয়ে শুধু উৎসবই হয়, মাছটার কথা কেউ ভাবে না।” মাসুল তো গুনতেই হবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE