Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অঘ্রানের ধোঁয়ায় ঢাকছে গাঙবাংলা

আবাদ শেষে ‘নাড়া’ পুড়িয়ে জমি সাফ করার সেই নব্য অভ্যাসে শীতের সকালে জমে থাকা ধোঁয়ায় হাঁসফাস করছেন মানুষ।

ধোঁয়ায় ঢাকা। —নিজস্ব চিত্র।

ধোঁয়ায় ঢাকা। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৪৯
Share: Save:

ছায়াটা যেন হরিয়ানা থেকে উড়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে গাঙ বাংলায়।

আবাদ শেষে ‘নাড়া’ পুড়িয়ে জমি সাফ করার সেই নব্য অভ্যাসে শীতের সকালে জমে থাকা ধোঁয়ায় হাঁসফাস করছেন মানুষ। শ্বাসকষ্ট থেকে ঘঙঘঙে কাশি— উত্তর ভারতের সেই ধোঁয়া ঢাকা গ্রামের অবিকল ছবিটা ছেয়ে থাকে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের আকাশে।

অঘ্রাণের সন্ধ্যা নামতেই নদিয়া মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, হুগলি— বিঘার পর বিঘা ফসলহীন ন্যাড়া মাঠ জুড়ে ধিকিধিকি জ্বলছে আগুন। নাড়ায় গেঁজে ওঠা মাঠে আগুন লাগিয়েছে চাষিরা। মাঠে মাঠে তাই অকাল দীপাবলি যেন। গাঢ় সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। হেমন্ত আকাশ থেকে নেমে আসা চাপ চাপ কুয়াশার সঙ্গে মিশে তৈরি হয়েছে দুর্ভেদ্য ধোঁয়াশার আস্তরণ। ক্ষেত লাগোয়া গ্রামের ছেলেবুড়ো ওই ধোঁয়াশায় কেমন যেন হাঁফিয়ে ওঠে। ক্ষেতের কাছে গেলে দমবন্ধ হয়ে আসে। সে ধোঁয়া উড়ে এসে ছেয়ে ফেলছে মাঠ ঘেঁষা গার্মের পর গ্রাম।

এ যাবত ছটফট করেছে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশের গাঁ-গঞ্জ, যার আঁচ পড়েছে খোদ দিল্লিতেও। এখন তারই ছায়া এ রাজ্যে। কার্তিক অঘ্রানে ফসল কাটা এবং ঝাড়াইয়ের পরে সস্তায় ক্ষেত সাফ করার সহজ উপায় হিসাবে তাঁরা পুড়িয়ে দেন ফসলের অবশিষ্টাশ। যার প্রভাবে মারাত্মক দূষণ এবং ধোঁয়াশায় খোদ দিল্লির মতো শহরে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায়। দিনের পর দিন স্কুল কলেজ অফিস আদালত বন্ধ করে দিতে হয়। বাতিল হয় বাস ট্রেন থেকে আন্তর্জাতিক উড়ান।

নাড়া পোড়ানোর সেই কুঅভ্যাসই ক্রমশ রপ্ত করছেন এই রাজ্যের চাষিরাও। বিভিন্ন জেলার কান্দি থেকে করিমপুর কিংবা মন্তেশ্বর থেকে মুরুটিয়া। মূলত আমন ধান এবং গমচাষের পর জমি সাফ করতে নাড়া পুড়িয়ে দেওয়ার সহজ কিন্তু বিপ্পজনক উপায়টিকে বেছে নিচ্ছেন চাষিরা। এই বদ অভ্যাস থেকে চাষিরা যাতে বেড়িয়ে আসতে পারেন তার জন্য শুরু থেকেই উঠে পরে লেগেছে রাজ্যের কৃষি দফতর। লিফলেট হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে নাড়া পোড়ানোর বিপদ নিয়ে প্রচারে নেমেছেন জেলার কৃষিকর্তারা।

তাঁদের কথায় ফসল পোড়ানোর ক্ষতির দিক দুটি। পরিবেশগত এবং কৃষিগত। রাজ্য সরকারের কৃষি বিভাগের হ্যান্ডবিলে বলা হয়েছে ধান কাটা ঝাড়ার জন্য মেশিন ব্যবহারের পর জমিতে বড় বড় খড়ের টুকরো পড়ে থাকছে। ওই টুকরো বা নাড়ায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় ব্যপক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে জমির। মাটিতে থাকা কেঁচো, বিভিন্ন পোকারা যাচ্ছে মারা। মাটি পুড়ে ইটের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। সারের অপচয় ঘটছে এবং ফলন কম হচ্ছে।

বর্ধমানের সহ কৃষি অধিকর্তা পার্থ ঘোষের কথায়, ‘‘যত দিন এ রাজ্যে চাষ আবাদ শ্রম নিবিড় ছিল তত দিন এ সমস্যা ছিল না। এখন শ্রমিকের বদলে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। চাষের কাজে পর্যাপ্ত শ্রমিক মিলছে না। তাই ফসল কাটা থেকে চাষের পর জমি তৈরি করা সব কিছুর জন্য যন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছেন চাষিরা।’’ তারই প্রভাবে এই ধরনের অভ্যাস গড়ে উঠছে। বর্ধমানের মন্তেশ্বর বা নদিয়ার করিমপুর তেহট্ট থেকে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চলে নাড়া পোড়ানো কথা মেনে নিয়েছেন জেলার কৃষি আধিকারিকরা। নদিয়া উপ-কৃষি অধিকর্তা রঞ্জন রায়চৌধুরী বা মুর্শিদাবাদের উপ-কৃষি অধিকর্তা তাপস কুণ্ডু জানান, দুই জেলাতেই নাড়া পোড়ানো হচ্ছে। তবে বন্ধ করতে বদ্ধ পরিকর তাঁরা। তাপস বলেন, “গমচাষ নিষিদ্ধ করায় দুই জেলাতে নাড়া পোড়ানো কিছুটা কমেছে।” সঙ্গে প্রচারও হচ্ছে। তা হচ্ছে, কিন্তু চাষিরা তা শুনবেন তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Smoke Burnt Village
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE