Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ফোনে কথা শেষ হল না, হারিয়ে গেল প্রকাশ

পোস্তার জট কাটিয়ে গণেশ টকিজের মোড়ের কাছাকাছি আসতেই ফোনটা বেজে উঠেছিল। সামনে পেল্লাই একটা সরকারি বাস, খান দুই ট্যাক্সি— একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছিল প্রকাশের সাদা টাটাসুমো। ফোনটা কানে তুলতে গাড়ির গতি আরও একটু পড়ে গিয়েছিল।

ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে রিঙ্কুদেবী।নিজস্ব চিত্র

ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে রিঙ্কুদেবী।নিজস্ব চিত্র

সুপ্রকাশ মণ্ডল
গয়েশপুর শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৪৭
Share: Save:

পোস্তার জট কাটিয়ে গণেশ টকিজের মোড়ের কাছাকাছি আসতেই ফোনটা বেজে উঠেছিল। সামনে পেল্লাই একটা সরকারি বাস, খান দুই ট্যাক্সি— একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছিল প্রকাশের সাদা টাটাসুমো। ফোনটা কানে তুলতে গাড়ির গতি আরও একটু পড়ে গিয়েছিল।

সামনের আসনে প্রকাশের পাশেই বসে ছিলেন গোপাল দেবনাথ। বলছেন, ‘‘ফোনটা কানে তুলেই কপালে ভাঁজ পড়ল ছেলেটার। তার পর, ‘হ্যাঁ বল...অত চেঁচাচ্ছ কেন’, লাইনটা কেটে দিয়ে তার পরেই দাদাকে ফোন করছিল প্রকাশ।’’ তবে দু’একটা কথার পরে আর গড়ায়নি। একটা বিকট শব্দ আর চোখের সামনেটা ধুলোয় ভরে গেল।’’ সেকেন্ড কয়েক পরে, ধুলো কাটলে তিনি দেখেছিলেন, প্রকাশ আর তাঁর মাঝে, এক চিলতে জায়গায় আড়াল তুলে দাঁড়িয়ে সিমেন্টের বিশাল এক চাঙড়।

একটা ফোন, কয়েকটা সেকেন্ড আর বুক চাপা একটা শব্দ—গুম। শুক্রবার বিকেলেও গোপালবাবুর আক্ষেপ যাচ্ছে না, ‘‘ফোনটা না এলে প্রকাশ ঠিক ওই জায়গাটা পেরিয়ে যেত, অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল তো!’’ গাড়ির গতিটা পড়ে গিয়েছিল তাতেই। ভেঙে পড়া বিবেকানন্দ সেতুর আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার আগে কার ফোন পেয়েছিল প্রকাশ?

হরিণঘাটার দায়বেড়িয়ায় প্রকাশ ঢালিদের বাড়ির উঠোন পা দিতেই বন্ধ ঘর থেকে ছিটকে এল কান্না, ‘‘ফোনটা এখনই করতে হোল রে তোকে!’’

পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে ফোন করেছিলেন প্রকাশের স্ত্রী। তিন বছর আগে যাঁর সঙ্গে সম্পর্কটাই প্রায় ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। তাঁর এক আত্মীয় জানাচ্ছেন, কখনও কেমনে বাপের বাড়ি থেকে এসে ‘অশান্তি পাকিয়ে’ যেত ওই মহিলা। তিনি বলছেন, ‘‘ওই দিন সকালেও বউদি এসেছিলেন। তারপরে দাদার পোন নম্বরটা নিয়ে বাড়ি তেকেই ফোন করেছিলেন। হয়তো দাদার সঙ্গে একটু কতা কাটাকাটিও হয়েছিল। সেই সময়েই ভেঙে পড়ে ওই উড়ালপুল।’’

বাড়িতে প্রকাশ ঢালির বাবা।

গোপালবাবুও বলছেন, ‘‘আসলে গাড়িটা যে গতিতে যাচ্ছিল, ফোনটা না এলে অনায়াসে আমরা ওই জায়গাটা পেরিয়ে যেতাম। ফোন আসায় গাড়ির গতি একটু আস্তে করে দিয়েছিল প্রকাশ।’’ আর, ওই সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে ভেহে পড়েছিল উড়ালপুল। তার জেরেই ঢালি পরিবার জুড়ে চাপা হা-হুতাশটা শুক্রবার বিকেলেও যেন কাটতে চাইছে না।

প্রকাশের দাদা সমরেশ বলছেন, ‘‘বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ ওর স্ত্রী বাড়িতে এসে হাজির। বাড়িতে তখন বাবা একা। প্রকাশকে না পেয়ে সরাসরি ফোন করে বসে।’’ তিনি জানান, এর পরেই প্রকাশ আমাকে পোন করে বলছিল, ‘দাদা একটু দেখ তো ও (স্ত্রী) আবার এসেছে, কী সব বলছে’ কথাটা আর শেষ হয়নি।’’

লাইন কেটে যাওয়ার মিনিট পনেরো পরেই আবার এসেছিল ফোন। সমরেশ বলছেন, ‘‘এ বার গাড়ির খালাসি। ওর কাছেই শুনলাম, গাড়িটা দুমড়ে মুছড়ে প্রকাশকে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে!’’ আক্ষেপ যাচ্ছে না তাঁরও, ‘‘ওর বউ যদি ওই সময় ফোনটা না করত...’’'

মাটির বাড়ি, টালির চাল। দাওয়ায় বসে এক বৃদ্ধ, নিতাই চন্দ্র ঢালি। কোঠরে ঢুকে যাওয়া দু' চোখের কোলে অবুঝ কান্না। কানে ভাল শোনেন না। বিড় বিড় করছেন, ‘‘ক’দিন ধরেই বলছিল, তুমি না থাকলে অনেক দূরে চাকরি নিয়ে চলে যাব। আর কত দূরে যাবি বাবা!’’ বৃদ্ধ ফের ফুঁপিয়ে ওঠেন।

কান্না এখনও দলা পাকিয়ে রয়েছে গয়েশপুরের গোকুলপুরেও। প্রকাশের গাড়ির পিছনের আসনে বসেছিলেন সুজিত। তাঁর রক্তাক্ত দেহটা বের করতে পেরিয়ে গিয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। তাঁর স্ত্রী রিঙ্কি দেবনাথ এখনও মোবাইলে স্বামীর রোদ চশমা পরা ছবিটা আঁকড়ে বসে রয়েছেন। অন্যমনস্ক হয়ে বলে চলেছেন, ‘‘কেমন লাগছে দেখ, এত শখ সব রক্তে ভেসে গেল!’’ বার বার বলছিলেন, ‘‘আমার ছেলে-মেয়ে আর বোনটাকে তো আমিই টেনে গাড়ি থেকে বের করলাম, কিন্তু ওকে পারলাম না কেন!’’

ডুকড়ে কেঁদে উঠছেন মহিলা। ' মা’কে কাঁদতে দেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করছে আড়াই বছরের ছোট্ট রূপসাও। ঠাকুমার কোলে চড়ে বলছে, ‘‘আমি আর গাড়িতে চড়ব না।’’ পাশেই বসেছিল রূপসার সাত বছরের দাদা শুভ্রজিৎ। সে এখনও জানে না যে, তার বাবা আর ফিরবে না। তার বদ্ধমূল ধারণা, বাবা হাসপাতাল থেকে ফিরলেই মোটর বাইকে করে তাকে ঝিলের ধারে বেড়াতে নিয়ে যাবে। সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে দুপুরের রোদে।

একটা ফোন, কয়েক সেকেন্ড সেই অপেক্ষাকে দীর্ঘ করে দিয়েছে যেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

flyover collapse
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE